ধ্রুবদা'র বাসায় বসে আছি, সামনে বইমেলা। নাকেমুখে প্রকাশক লেখক সবাই কাজ করে যাচ্ছে। আমরা তিনজন বিধান ভাই, রুমী ভাই আর আমি সাত সকালে এসে আমাদের ছোটদের বার্ষিকী 'ঘুড্ডি' নিয়ে ওনার সাথে বসেছি। এর গ্রাফিক্স কি হবে, ফন্ট কোন সাইজ হলে ভাল, পুস্তানী দেয়া হবে কি না। কথায় কথায় এর ভূমিকা কে লিখবে সেটা তোলা হল। ধ্রুবদা' ওনার নিজের বানানো মেরুন রঙ চা য়ে চুমুক দিতে ওনার সানুনাসিক স্বরে বললেন-
'হুমায়ূন আহমেদকে বললে উনি লিখে দেবেন, আর উনি লিখলে সেটাই একটা সাহিত্য হয়ে যায়। সত্যি কথা আর কোন লেখকের শুধু দুই লাইন ভূমিকা পড়লে কী তোমার কখনো বুকের মধ্যে টনটন করবে বল? এই একটা লোক সেটা পারে'
কথাটা আমরা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। এবং ঠিকই স্যারের বাসায় গিয়ে আমাদের বার্ষিকীর জন্যে একটা ভূমিকা জোগাড় করেছিলাম। উনি খুশী মনে সেটা লিখে দিয়েছিলেন।
ধ্রুবদা'র সেই একটা কথাতেই কি এই অসাধারণ মানুষটাকে বোঝা হয়ে যায় না? ছোট একলাইনের ভূমিকা ধরনের লেখাতেও কি অনায়াসে এই একজন পরাবাস্তব একটা জগতে মানুষকে টেনে নিয়ে যেতে পারেন। এমন অনায়াস আটপৌড়ে ঢঙ্গে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত অন্দরমহলের ভাবনাটা কি আর কেউ বলে যেতে পেরেছেন? কোনরকম দেখনদারি সাহিত্যের মারপ্যাঁচের ধাঁধাঁয় পাঠককে নাকানী চোবানী খায়িয়ে বাহবা কূড়োনোর লোভ সামলিয়ে ক'জন সৎভাবে নিজের মত করে লিখে যেতে পেরেছেন? ক'জন লেখক অকপটে বলে ফেলতে পেরেছেন- আমি বাজারে লেখক? বাজারের সবার জন্যে লিখি, ড্রয়িংরুমে সাজানোর জন্যে না? তার মত করে পুরো একটা জাতির মননে মানসে এমন সুদুরপ্রসারী ছাপ ফেলার সৌভাগ্য বোধ করি তাঁর চেয়ে প্রতিভাবান সাহিত্যিকদেরও ঘটেনি। গল্প, উপন্যাস, সিনেমা, নাটক- এমনকী গণমাধ্যমের বিরাট অঙ্গন জুড়ে তাঁর যে বিপুল অবস্থান তা বাংলাদেশের আনাচা কানাচে এভাবে আর কোন সাহিত্যিকের ভাগ্যে জোটেনি, জুটবে তেমন আর বলাও যাচ্ছে না। তাঁর সাহিত্যবোধ নিয়ে কিছু অকালপক্ক 'পাঁঠক' সমালচনা করে গণতান্ত্রিক অধিকার ফলান। অনেক পোস্ট-কলোনিয়াল সমাজের বাই-প্রডাক্ট তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সাহিত্য গুলিয়ে ফেলেন। এসবে তাঁর থোড়াই পরোয়া,স্বভাবসুলভ সেন্স অব হিউমারে এসব তিনি উড়িয়ে দেন। মোটামুটি বোধ সম্পন্ন পাঠকমাত্রই জানেন তাঁর সমগ্র সাহিত্যের প্রচ্ছন্ন পরাবাস্তবতার কথা। এক অদেখা জগৎ নিয়ে তাঁর বারবার জানানো আকুতির কথা। একটা নিবিড় গাঢ় অভিমান যেন মেখে থাকে সব কিছুতে। এমনকী প্রবল ভাঁড়ামি বলে নাক সিঁটকোতে ইচ্ছে করে যে লেখায় সেখানেও যেন এক সারকাস্টিক-স্টোয়িক অদ্ভূত মানসিক টানাপোড়েন খুঁজে পাওয়া সম্ভব। একইসাথে কি ভয়ানক জীবনবোধ আর রসবোধ। বাংলাদেশের 'সাহিত্যিকেরা' তাই ওনাকে সাহিত্যিক বলুক বা না বলুক উনি তাঁর আসল জায়গা ঠিকই করে নিয়েছেন- পাঠকের হৃৎপিন্ডের কাছাকাছিতে। সেই হুমায়ূন আহমেদ আজ ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে আমেরিকার এক হাসপাতালে কোমায় পড়ে আছেন। জানি আমাদের এই এখানে বসে কিছুই করার নেই। শুধুমাত্র তাঁর জন্যে বরাদ্দ জায়গাটুকু থেকে উৎসারিত শুভকামনা জানানো ছাড়া। ভালোবাসা ছাড়া।
হুমায়ূন আহমেদ, সুস্থ হয়ে উঠুন! আমাদের জন্যে। আমাদের আর কেউ নেই। আপনাকে ফিরে আসতেই হবে। তোমার জন্যে আমাদের দেবার আর কিছুই নেই, শুধু ভালোবাসা ছাড়া।
তোমার জন্যে ভালোবাসা
----------------