December 07, 2017

অনলাইন ড্রয়িং কোর্স: CGMA

ইদানীং ড্রয়িং এর অবস্থা যা-তা। এনাটমি, কালার লাইট শেড, এনভায়রনমেন্ট সবই আঁকতে বেশ কষ্ট হচ্ছে, কারণ আঁকার সময় খেয়াল করি সেই গত কয়েক বছর এই একই জিনিস এঁকে যাচ্ছি, শিখছি না। একটা লেভেল আপের দরকার অনেক দিন থেকেই। সবচেয়ে বিপদ হয় কমিক্সের ক্যারেক্টার করতে। এক ক্যারেক্টার একেক ফ্রেমে একেকরকম হয়। ওদিকে ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখে শেখার সমস্যা হল একেক জন একেক ভাবে বলছে, আর সেটা দেখে দেখে করলে সেটার ফিডব্যাক তো আর পাচ্ছি না। তাই জীবনে প্রথম একটা অনলাইন আর্ট কোর্স করলাম। FUNDAMENTALS OF CHARACTER DESIGN with আহমেদ আলদুরিব্রেট বিন (এই দুইজনের কাজ অবশ্যই দেখবেন সবাই) under CGMA  ।
জীবন শেষ করে দিলো ব্যাটারা, আঁকতে আঁকতে হাত ব্যাথা, একেবারে সেই গোড়া থেকে আবার সব শুরু, জেশ্চার, সিলিন্ডার, ফর্ম, রেফারেন্স ফটো স্টাডি। সব শেষে যে কোন একটা থিম ঠেকে একটা পূর্ণ ক্যারেক্টার তার গল্প সহ তোইরী করা। আমি আমাদের আদিবাসী থিমের সাথে সাই-ফাই মিলিয়ে একটা ক্যরেক্টার করেছি শেষে।
কোর্স করে মহা আর্টিস্ট হয়ে গেছি তা না, কিন্তু কি কী সমস্যা আছে সেটা জেনেছি। এটাই একটা বিরাট মোটিভেশন। আশা করি আঁকা নিয়ে আরো সিরিয়াস হব এখন থেকে।
বিঃদ্রঃ ইহা হয় একটি দামী কোর্স, সিনটিক কেনার জন্যে যেই টাকাটা স্পন্সর পেয়েছিলাম কার্টুনিস্ট মিতুর থেকে, দিন শেষে দু'জনেরই মনে হল সেটা দিয়ে একটা গেজেট না কিনে বরং কিছু শিখি। আশা করি বেটার ইনভেস্ট ছিলো।

















December 04, 2017

টেক্সট বই প্রিন্ট আপডেট

জীবনের এ পর্যন্ত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট শেষের পথে। পৃন্ট মিডিয়ার কাজ যতই ভাল হোক সব পৃন্ট হাতে না আসা পর্যন্ত আতংক গলার কাছে আটকে থাকে। কখন কোথায় কী ঘটে যায় বলা যায় না। যেমন এবারেই টেক্সট বইয়ের পৃন্ট ভার্সন করার আগে যা হল তা নিয়ে 'ছাপাখানার ভুত ভুতং ভুতৌ ও অন্যান্য' নামে একটা বই লিখে ফেলা যাবে। পৃন্ট শুরু হবা এক সপ্তাহ আগে কি মনে করে সব পেইজ খুলে চেক দিচ্ছিলাম। হাজার ফাজার পৃষ্ঠা একটা একটা করে ইপিএস ফরম্যাট দেখার একমাত্র সহজ উপায় হল এডোবি ব্রিজ এ থাম্ব ভিউ দিয়ে জুম করে দেখা। তাতে যা যা ধরা পড়ল তা দেখে আক্কেল গুড়ুম সবার। এডোবির অতি স্মার্ট ইপিএস এক্সপোর্ট পদ্ধতি যত ধরনের ফর্মুলা আছে সব পালটে আরেকটা ফন্ট করে দিয়েছিলো। অতঃপর এনসিটিবির অফিসে গিয়ে মূল গ্রাফিক অপারেটরের সাথে বসে পুরো টিম মিলে বলতে গেলে আবার সব ধরে ধরে সব পৃষ্ঠা ঠিক করতে হয়েছে, কষ্টের কাজটা এনসিটিবির টিমই করেছে শেষে। সব ঠিক করার পরেও মনের মধ্যে এবার ভয় ঢুকে গেল। বিকট সব স্বপ্ন দেখা শুরু হল আমার আর মিতুর।
আমি দেখলাম, স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা, আমার বায়োলজি স্যার প্রশ্ন দিতে দিতে হাসিমুখে বললেন-

- 'সব কিন্তু এজ ইটিজ আঁকবি। আর মনে রাখবি, সব রঙ করতে হবে।' 
- 'রঙ করার টাইম হবে না স্যার' আমি আতঙ্কে বললাম।
- 'টেক্সট বই আঁকার সময় খেয়াল ছিলো না? হাহাহাহা' (কুৎসিত হাসি)

আমার সবচেয়ে প্রিয় বায়োলজি স্যারের এইরকম শত্রুতা দেখে জেগে উঠে পরদিন আবার মিতু দেখলো ফিজিক্স বইয়ের সব ফন্ট সফটওয়ারের কারণে চাইনিজ ফন্ট হয়ে গেছে। এবং বাংলাদেশের সব পত্রিকায় এ বিষয়ে চীনের শি জিন পিং আনন্দ বার্তা জানিয়েছেন।

এইসব কারণে আমরা মুখ শুখনা করে ঘোরা শুরু করলাম। মিডিয়ার কল্যাণে আর নিজে পণ্ডিতি করে ব্লগে লিখে দুনিয়ার সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি আমরা এই প্রজেক্টে আছি, তাই পরে পালানোরু উপায় নেই। হঠাত একদিন স্যারের ফোনে জানলাম পৃন্ট শুরু হচ্ছে। শুনে রীতিমত প্রেশার হাই হয়ে গেল আমাদের। এবং কিছুদিন পর আবার একদিন স্যারের কল আসলো। এনসিটিবি থেকে তাঁকে দাওয়াত করা হয়েছে কিভাবে পৃন্ট হচ্ছে তা দেখতে। আমরা যেতে চাই কি না। অবশ্যই চাই। এক শুক্রবার সকালে এনসিটিবির কর্মকর্তা রতন সিদ্দিকী তাঁর বিরাট গাড়ি নিয়ে এলেন স্যারের বাসায়। রওনা হলাম, স্যার, ইয়াসমীন ম্যাডাম, স্যারের মেয়ে ইয়েশিম আর আমি-মিতু। প্রেস নাকি সব মাতুয়াইলে! এত দূরে যেতে হবে আগে বুঝিনি। কিন্তু বড় বড় সব প্রেস নাকি সব ওখানেই। বিশেষ করে এনসিটিবির পৃন্ট ওখানেই হয়। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ প্রিন্টিং। ৩৫ কোটি বই প্রতি বছর! স্যারের এনালাইসিস সব বই পর পর রাখলে পুরো পৃথিবী ৬ বার প্রদক্ষিণ করতে পারবে। এটা একটা বিশ্ব রেকর্ড, প্রজেক্টটা করার আগে আমার কোন ধারনা ছিলো না। এবং মাতুয়াইলে গিয়ে প্রেস দেখে আমি আর মিতু একসাথে বললাম- 'বাপরে!' 

গলি তস্য গলি পাড় হয়ে যেই প্রেসেই ঢুকি সেখানে এলাহী কাণ্ড। মেশিনের পর মেশিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একের পর এক বই বের হচ্ছে। এখানে বড় বড় শিট হাতে ভাঁজ করে ফর্মা (সবচেয়ে বড় যে শিটে একসাথে ছাপা হতে পারে, পরে এটাকে ভাঁজ দিয়ে বা কেটে বইয়ের মাপে আনা হয়) করা লাগে না। মেশিনই ফর্মা ভাঁজ করে দেয়। আর পৃন্ট থেকে বাইন্ড পর্যন্ত ধরে একটা প্রেস দিনে বই ছাপতে পারে এক লক্ষ! আমার আগে ধারনা ছিলো শুধু চায়নাতেই এটা করা যায়। এবারে জানলাম আমাদের পৃন্টিং কত দ্রুত আরো কত পেশাদারি জায়গায় চলে যাচ্ছে। আর পৃন্ট? আমার আগের দেখা যে কোন টেক্সট বইয়ের চে' কাগজ ভালো, পৃন্ট কোয়ালিটিও দারুণ। দুই এক জায়গায় টুকটাক কারিগরি সমস্যা যে হচ্ছে না তা না। তবে এখন থেকে আর আমরা দুঃস্বপ্ন দেখবো না আর এটা নিশ্চিত। লেখা আর না বাড়িয়ে ছবিতে আর ভিডিওতে বাকিটা শেষ করা যাক।


পদার্থবিজ্ঞান আর জীববিজ্ঞানের ফুল শিট প্রচ্ছদ সহ আমি, প্রেস মালিক (নাম মনে নেই :/) ইয়াসমীন ম্যাডাম, স্যার, মিতু

ঝকঝকে রসায়ন বই।

সরেজমিনে পৃন্টিং দেখতে স্যার একটা মেশিনের পাটাতনে, বাঁয়ে প্রেসের ম্যানেজার (নাম মনে নেই :/) ডানে রতন সিদ্দিকী সাহেব।

(নাম মনে নেই -ম্যানেজার) স্যার, ম্যাডাম, আর স্যারের মেয়ে ইয়েশিম।  

জীববিজ্ঞান (জেনারেল লাইন)

জীববিজ্ঞান (মাদ্রাসা লাইন)

সরেজমিন


প্রিন্টিং প্রক্রিয়া



বাঁধাই চলছে





November 01, 2017

পুরানো কাজ

সেন্ট মেইলবক্স খালি করতে গিয়ে খুঁজে পেলাম, ২০০৯ সালের আঁকা। ব্র্যাকের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথের বার্ষিক প্রতিবেদনে ইউপিএলের মাহরুখ আপুর জন্যে করা। বেশ মজা পেয়েছিলাম কাজগুলি করতে। আজকাল আর নিব পেনে আঁকা আর মাউসে রঙ করা কাজ খুঁজে পাই না। এগুলি পেয়ে মজা পেলাম তাই।
ছোটখাটো অসুখে ডাক্তারদের ধরিয়ে দেয়া প্রেসক্রিপশন।

মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভরা যেভাবে ডাক্তারদের নিয়ন্ত্রণ করে। এটা শুধু আমাদের দেশে না,
খোদ আমেরিকার চিত্র দেখতে চাইলে কেউ মাইকেল মুরের 'Sicko' ডকুমেন্টারিটা দেখে নিতে পারেন।

সিটীজেন চার্টারের 'দুরাবস্থা' 'আ' কার দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

October 31, 2017

মথ-ক্যারেক্টার

সিঁড়ির গোড়ায় একটা মথ মরে পড়ে ছিলো, আগে স্টাডি করা হয়নি কখনো, নিয়ে এসে টুকটাক স্কেচ করলাম, কালারটা প্রায় এনালোগাস, সেটা থেকে একটা ক্লিশে টাইপ ক্যারেক্টার আঁকলাম। ক্লিপ স্টুডিওর ব্রাশের মিক্সড গ্রাউন্ড কালার অপশনটা ভাল লাগলো বেশ।


October 30, 2017

চতুর্ভূজ-ত্রিভূজ পদ্ধতি

যে কোন জটিল ফর্মকে প্রথমে বড় কোন বেসিক ফর্মে আটকে নিলে পরে আঁকা সহজ হয়। যত জটিলই হোক না কেন যে কোন জটিল ফর্ম আসলে অসংখ্য ছোট ফর্ম দিয়েই তৈরি হয়। আর এভাবে সহজ বড় ফর্মে আগে আটকে নিলে এর পর ধীরে ধীরে অন্য ছোট ফর্ম যোগ করলে আরেকটা ভাল ব্যাপার ঘটে, সেটা হল- স্টাইল। সরাসরি রিয়েলিস্টিক ছবি থেকে এভাবে আঁকা প্র্যাকটিস করলে নিজে নিজেই একটা মজার স্টাইল তৈরী হতে থাকে। উদাহরণ দেয়া যাক।


দেখতে মোটামুটি জটিল এই গাছকে চাইলে এভাবে একটা চতুর্ভূজে আটকে নেয়া যায়, চাইলে একটা বৃত্তেও আটকানো যেত। কিন্তু এটা সবদিকে সমান টাইপ না, বরং এভাবে আঁকাবাকা চতুর্ভূজে আটকালে পরে ডিটেইল করা সহজ হতে পারে। এই কাজটা কিন্তু সহজ না। গাছটার দিকে তাকিয়ে একটা ফর্মে ভাবা আসলে প্র্যাকটিসের ব্যাপার। দেখার চোখ তৈরী করা আঁকার চাইতে জরুরী। গাছটার কান্ড একটা উলটা ভি সাইন দিয়ে আপাতত করে রাখা হল।
এবারে খুব গুরুত্বপূর্ণ আরেকটা কাজ। আসলে আমরা যেহেতু একটু ডিটেইলে যেতে চাচ্ছি- সে ক্ষেত্রে চতুর্ভূজের ওপরে এভাবে কিছু ত্রিভূজ দিয়ে ভরাট আর ফাঁকা জায়গাগুলি আটকাই। মানে কোথাও কোথাও কিছু পাতা চতুর্ভূজের মূল ফর্মেরর বাইরে চলে গেছে, সেগুলিতে বাইরে ত্রিভূজ, আর যেসব জায়গায় ভেতরে আসলে কোন পাতা নেই, খালি জায়গা সেগুলি ভেতরে ত্রিভূজ এঁকে আটকানো হল।

এবারে পাতা টাতা ইচ্ছামতন আঁকা হলে জিনিসটা দাঁড়াবে এরকম। খেয়াল করার আছে একেবারে ত্রিভূজ বা চতুর্ভূজের মধ্যেই কিন্তু পাতা আঁকা থেমে থাকেনি, বেশ কিছু জায়গায় বাইরে গেছে। তবে সেটা মূল গাইডলাইনটাকে মেনেই।

শেষমেশ জিনিসটা দাঁড়ালো এমন। এমনিতে গাছটা দেখে দেখে এটা আঁকা সহজ ছিলো না। কিন্তু এই ত্রিভূজ-চতুর্ভূজ নিয়মে দেখতে দেখতে বেশ দেখনসই একটা স্টাইলাইজড গাছ এঁকে ফেলা গেল। চ্যালেঞ্জ নিতে চাইলে তিন ধরনের আরো তিনটা গাছ এঁকে এখানে পোস্ট করুন।





October 23, 2017

Demon challenge

ফেইসবুকের দুর্দান্ত গ্রুপ Character Design Challenge প্রতি মাসে নতুন ক্যারেক্টার ডিজাইন প্রতিযোগিতা ছাড়ে। কত মহা মহা আঁকিয়ে যে এখানে কাজ দেয়! অসামান্য সব কাজ খালি মুগ্ধ হয়ে দেখি। এবারে ছিলো ডেমন- মানে শয়তান। ক'দিন আগেই নেপাল ঘুরে এলাম সে সময় হিন্দু ও বৌদ্ধ ডেমনোলজির দুটো ছোট বই কিনেছিলাম, Ritual objects and Deities: An iconography on Buddhism and Hinduism (এটা অবশ্য মিতু কিনেছে). আরেকটা স্রেফ-Himalayan Folklore: Ghosts and Demons from West NEPAL (এটা আমি)। এই জিনিস নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখি হিন্দুইজম বা বুঢিজম এ কোন পরম শয়তান বলে কিছু নেই। সেমিটিক ধর্মগুলিতে যেমন একদিকে ইশ্বর আরেকদিকে শয়তান এখানে ব্যাপারটা তা না। আমি এদ্দিন শয়তানের মুখোশ বলে যা সব দেখে এসেছি যেমন কালভৈরব, বজ্রকিলা, বজ্রপানি, বা যে কোন 'লাখে' এগুলো আসলে উলটো ভাল জিনিস। মানে এরা বরং অশুভকে বিতারণে ব্যস্ত। যাই হোক মাঝখান থেকে বেশ কিছু মাস্ক আর সেই ইলাস্ট্রেটেড বইয়ের কিছু মোটিফ স্টাডি করেছিলাম, সেগুলি মিলিয়ে ঝিলিয়ে সেই গ্রুপেও দিলাম। সাথে সাথে সেটা শ'খানে অসামান্য কাজের আড়ালে কই চলে গেল। 

এঁকে দারুণ মজা পেয়েছি। ভাবলাম ব্লগে তুলে রাখি এইবেলা।


বিমূর্ত শিল্পকলা ও আমাদের সংকট


শিল্পাচার্জ জয়নুল আবেদীনের দুর্ভিক্ষ সিরিজ থেকে। ছবির সোর্স

শিল্পী কেন শিল্প তৈরী করেন? এর আসলে কোন সহজ উত্তর নেই। সহজ উত্তর হল- তার ইচ্ছে করে তাই, তার ভালো লাগে তাই, অথবা তার খারাপ লাগে তাই। সোজা কথা কোন তীব্র আবেগ মানুষ নিজে নিজে ধারন করতে পারে না। তার কাউকে বলতে হয়। কাউকে জানাতে হয়। একটা সুন্দর বসন্তবৌরী পাখি প্রথমবারের মত কেউ দেখলে আগে নিজে অভিভূত হবে আর তারপরেই সে চাইবে আশেপাশে আর কাউকে দেখাতে। শিশু যেমন অদ্ভুত কিছু দেখলে সাথে সাথে সেটা আঙ্গুল দিয়ে কাউকে দেখাতে চায়, সেই একই কারণে। এটা অন্যের কাছে আরো উপাদেয় করে তুলতে পারে শিল্পী। শিল্পী মানে কিন্তু আঁকিয়ে বলা হচ্ছে না শুধু। চিত্রকলা, কলাবিদ্যার একটা মাধ্যম মাত্র। সব মাধ্যমেই কথা একই। মূল ব্যাপারটা হল- আমি যেটা দেখেছি বা ভেবেছি সেটার গল্পটা অন্যকে বলা। সেটা গানে, কবিতায়, নাটকে, সিনেমায় যেভাবে হোক বলা চাই।

এবারে ঠিক পরের কথাটাই হল এই বলাটা কে কাকে বলতে চাইছে?  শিল্পী যাকে বলতে চাইছে সে যদি ব্যাপারটা না-ই বোঝে তবে তা বলার মানে থাকে না। ধরা যাক আমি খুব দারুণ একটা চীনা গল্প পড়েছি। আমি চাচ্ছি অন্যেরাও সেটা শুনুক। আমি গল্পটা চাইনিজ ভাষাতেই পড়েছি কারণ আমি চাইনিজ জানি। এখন যেহেতু গল্পটা চাইনিজ আমি সেটা চাইনিজ ভাষাতেই আমার সব বন্ধুদের বললাম। ফলে যেটা হবে সব বন্ধুরা জানবে যে আমি চাইনিজ ভাষা জানি কিন্তু গল্পটা তারা বুঝবে না। তাদেরকে আমার আসলেই সেটা বোঝাতে হলে বলতে হবে তাদের ভাষায়। 

শিল্পের ক্ষেত্রে বিমূর্ত ভাবধারা একটা দারুণ উৎকর্ষ সন্দেহ নেই, কিন্তু যদি কেউ আশা করে সেটা সর্বসাধারণের বোঝা উচিত তবে আমার মতে সেটা এই বন্ধুদের চাইনিজ গল্প বলার মত ঘটনা। যাকে বলছি তার ভাষায় যদি বলা না যায় তবে বলার মানে নেই। তাই শিল্পীকে বলার আগে প্রথমে ভাবতে হবে এটা আমি কাকে বলছি? সবাইকে বলার কিন্তু দরকার নেই, হতে পারে চাইনিজ গল্পটা আমি যারা চীনা ভাষা জানে খালি তাদেরই বলছি। কিন্তু সেটা আগে নিজের কাছে নিজের পরিষ্কার থাকা দরকার। সবাই কেন চাইনিজ বোঝে না সেটা ভেবে সবাই যে আসলে অশিক্ষিত এবং আমি যে এদের থেকে আলাদা এটা বলাটা কতটা হাস্যকর তা আশা করি এই উদাহরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে। 

আমার কাছে মনে হয় আমাদের শিল্পকলায় এরকম দুই মেরু তৈরী হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একটি অতি বিমুর্ত, অন্যটি অতি খেলো। খেলো শিল্প বলতে আমি সেইসব কাজের কথাই বলব যা আসলে শিল্পের তাড়নায় হয় না, হয় শুধুমাত্র অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠতে। বিমূর্ত চিত্রকলা বা শিল্প থাকাটা জরুরী, আর খেলো লাফালাফিও সমাজ থেকে নাই হয়ে যাবে না, সেটা বরং সাময়িক গণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তাও পাবে। কিন্তু এসব বাদ দিয়ে আরেকটা অতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা খালি হয়ে যাচ্ছে সেটা হল- মধ্যপন্থার শিল্প, মানে যা বিমূর্তও না, অকারণে জনপ্রিয় হবার লাফালাফিও না, সেটার ব্যাপক অভাব দেখা যাচ্ছে।  শুধু চিত্রকলা নিয়েই যদি বলি কতিপয় ব্যাতিক্রম ছাড়া আমাদের অসম্ভব গুণী শিল্পীরা কিন্তু চাইনিজ গল্পই বলে যাচ্ছেন, আমরা বুঝতে পারছি না। ইউরোপীয় ভাববাদ ও বিভিন্ন ইজম তাঁরা মধ্যপন্থার বাংলায় ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। আমাদের নিজেদের ইজম গড়ে উঠছে না, আমরা দুর্বল অনুবাদেই আটকে আছি। একই সাথে চিত্রকলায় পপুলার ধারা শীর্ণ হয়ে আসছে। সমসাময়িক সমাজ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে শিল্পীরা কাজ করছেন না তা নয়, কিন্তু সেটা কেন জানি সুখপাঠ্য হচ্ছে না। দুর্বোধ্য সংকেতের মারপ্যাঁচে তা তাদের নিজেদের বৈঠকখানার চায়ের কাপেই আটকে যাচ্ছেন, মডার্নিজম পার হয়ে পোস্ট মডার্নিজম চলে যাচ্ছে, আমরা আমজনতা যেই তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছি। একটা বড় শিল্পীগোষ্ঠী ইউরোপমুখী যশাক্রান্ত বিধায় দেশের মানুষদের মূর্খ ভাবছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল প্রতিটা দেশই আলাদা, তার নিজস্ব একটা ইতিহাস থাকে, থাকে নিজস্ব দৃশ্য-ভাষা। সবাই চেনে ও জানে এমন ভাষায় না বলে আমি বাইরের ভাষায় বলে আশা করতে পারি না সবাই বুঝবে, এবং ইউরোপীয় দর্শন জানি না বলে আমি ততটা মূর্খ না যতটা সেই শিল্পী তার নিজের দেশের দর্শন না জেনে হচ্ছেন। 

এখন এ তো গেল সংকটের কথা, সমাধান কী? সমাধান এক কথায় বলা সহজ না, তবে যে কারণে এই লেখার অবতারণা সেটা হল- এই মুহূর্তে অসম্ভব প্রতিভাবান আঁকিয়ে ও শিল্পীর দারুণ একটা জাগরণ ঘটছে আমাদের দেশে। তাঁরা আঁকছেন, গাইছেন, শিল্প সৃষ্টি করছেন। তাঁরা তাঁদের উচ্চমার্গীয় বোধে আঁকুন সমস্যা নেই কিন্তু আমাদের নিজেদের ভাষার আঁকিয়েও খুব দরকার। যার গল্পটা বাংলায় বলা, যার গল্প বলে আসলেই কিছু আছে। শুধু আমি কতটা ভাল কাজ করি এটা দেখানোই উদ্দেশ্য না। আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যও থাকতে হবে সাথে। যা সবাইকে ভাবাবে ও একটা জীবনদর্শন দেবে। 'জনমানুষের জন্যে শিল্পই একমাত্র সার্থক শিল্প' এমন না হলেও জনমানুষের শিল্প সবচেয়ে প্রয়োজনীয় শিল্প বটেই। 

তাই শিল্পীদের আঁকা উচিত প্রথমে নিজেদের জন্যে তারপরেই নিজেদের আশাপাশের সবার জন্য। যাকে পাশে তাকালেই দেখা যায়। যাকে আঙ্গুল উঁচিয়ে দূরের বসন্তবৌরী দেখিয়ে বলা যায়। ইউরোপের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করলে সেটা অতদূরে না-ও পৌঁছাতে পারে। আর কোনভাবে পৌঁছালে দেখা যেতে পারে এরকম পাখি তারা ১০০ বছর আগেই ঢের দেখেছে। তাই পা নিজের মাটিতে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।

October 11, 2017

বাংলাদেশ কার্টুন ফেস্ট-২০১৭



বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট এসোসিয়েশনের বার্ষিক প্রদর্শনী অবশেষে ত্রি-বার্ষিকী আকারে হলেও শুরু হতে যাচ্ছে। মানে মাঝে প্রায় আড়াই বছর আমাদের কোন প্রদর্শনী নেই। কারণ? কারণ আর কিছুই না, স্পন্সর জটিলতা। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট যাদের করার কথা তারা বার বার শেষ মুহূর্তে জানাচ্ছিলো যে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু টাকার অভাবে কার্টুন প্রদর্শনী হবে না এটা ভাবতেই আমার মনে পড়লো সেই বছর ১৫ আগের করা প্রথম কার্টুন প্রদর্শনীর কথা। আক্ষরিক অর্থে পকেট ভোঁ ভোঁ। তখন মনে আছে আঁলিয়স ফ্রাঁসেজ গ্যালারি ছিল ফ্রি (এবং আমার ভুল না হয়ে থাকলে উলটো তখন যারা প্রদর্শনী করত তারা টাকাও পেত।) অন্য অনেক কার্টুনিস্টের মত আমারও কোন মোবাইল ফোন ছিল না। মনে আছে সবার নাম ঠিকানা নাম্বার অনেক কষ্টে জোগাড় করে একটা খাতায় লিখে নিয়েছিলাম, যেদিন সবাইকে কল দিতে হবে সেদিন সেই খাতা নিয়ে বের হয়ে মোড়ের ফোনের দোকানে যেতাম। ল্যান্ড ফোনে পার মিনিট ২ টাকা ছিল তাদের। এক টানা প্রায় তিরশটার মত কল করে থামতাম। দোকানদার ছেলেটা খুবই সন্দেহের চোখে তাকাতো যে ঘটনাটা কী? আমি তার সন্দেহ ভাঙ্গাতাম না। 

ফোনের পরের পর্ব ছিলো আরো কষ্টের, তখন ডিজিটাল কার্টুন বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। দুই একজন বিত্তশালী যাদের স্ক্যানার আছে তারা মাঝে  মাঝে কার্টুন স্ক্যান করে ফটশপে কিছু রঙ চং করত, ওইটুকুই। তার মানে সবই ট্রাডিশনাল হার্ড কপি। অর্থাৎ প্রত্যেকের বাসায় গিয়ে গিয়ে নিয়ে আসো। আমার তখন খুবই গরিবী দশা (এখনো)। ভাগ্য ভাল লোকাল বাসে তখনো ওঠা যেত, আর ছিল গরীবের বন্ধু টেম্পো। সব মিলিয়ে দিন দশেক ছোটাছুটি করে কার্টুনও জোগাড় করে ফেলা যেত। সমস্যা হত ফ্রেম নিয়ে। এটা তো আর ফ্রি পাওয়া যাচ্ছে না। গুরু আহসান হাবীব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লাগসই প্রজেক্ট হাতে নেন। তার একটা অংশ হিসেবে একবার করা হল ইলেকট্রিক চ্যানেলের ফ্রেম। মানে যেই প্লাস্টিকের ফাঁপা নল দিয়ে ইলেকট্রিকের লাইন ওয়ারিং করা হয় সেগুলি-ই ৪৫ ডিগ্রিতে কেটে কেটে জোড়া দিলে ফ্রেম বানানো যায়। এর চেয়ে সস্তা আর হয় না (যদিও প্রজেক্টটা প্রথমে সফল হয়নি, কেন জানি ফ্রেমগুলি কোণায় কোণায় ভালমত জোড়া লাগছিলো না) । এতেই কিন্তু শেষ না। প্রদর্শনীর লাগে পোস্টার, লাগে দাওয়াত কার্ড, লাগে ব্রোশিওর। একটা কাগজেই কিভাবে কেটেকুটে জোড়াতালি দিয়ে তিনটা জিনিস বের করা যায় সেটা সেবার দেখলাম। এবং আশ্চর্য ব্যাপার, দিনশেষে আঁলিয়সে যখন শুরু হল সেই প্রদর্শনী তখন কিন্তু এর পেছনের গরিবী হাল আর কারো চখেই পড়লো না। শেষে এসে দুর্দান্ত জম্পেশ হল সেই প্রদর্শনী। 

তার মানে সেই শূন্য হাতে (পকেটে) আমরা সেই ১৫ বছর আগের ইন্টারনেট বিহীন সময়ে যদি প্রদর্শনী করে ফেলতে পারি তবে এখন এই সময়ে এসে কেন পারবো না? যেই ভাবা সেই কাজ। আমাদের ৫ বছর ধরে অস্থায়ী অফিসে কারওয়ানবাজারের স্টার কাবাবে মিটিং চল্ল বারবার। ঠিক হল আমরা কার্টুনিস্টেরাই চাঁদা দিয়ে এবারের প্রদর্শনী করে ফেলব। হিসাব নিকাশ করে দেখা গেল তাতে মাথাপিছু খুবই অল্প পড়ছে। তাহলে আর বসে থাকা কেন? শুরু হয়ে গেল সব কাজ। ডিজিটাল যুগের সুবিধা টের পাওয়া গেল অচিরেই। ইভেন্টের মাধ্যমে সবাই জেনে গেল, মেইলের মাধ্যমে চলে এল কার্টুন। পৃন্ট হয়ে ফ্রেমে চলে গেল সব কাজ। শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রায় সবাই কাজ দিয়ে দিল। 

আগামীকাল বিকেল ৩ টায় শুরু হবে এবারের প্রদর্শনী, আমাদের প্রদর্শনী। অনেকটা পদ্মা সেতু করে ফেলার অনুভূতি হচ্ছে। স্পন্সর ছাড়াই এ সময়ে এত ব্যাবহুল একটা কাজ আমরা সবাই মিলে করে ফেললাম।
এবং এবারের ফ্রেমগুলি কাঠের :D

সবাইকে প্রদর্শনীতে আসার অনুরোধ জানাই।





September 22, 2017

Cartoon on Rohingya issue at Cartoon movement

cartoon movement নামে আন্তর্জাতিক পলিটিক্যাল কার্টুনিস্ট পোর্টালে বেশ আগে থেকেই একটা একাউন্ট ছিল। খুব বেশী আন্তর্জাতিক কার্টুন করা হয় না বলে পোস্ট কম করি। তবে এবারে হঠাত খেয়াল হল মায়ানমার ইস্যুতে তো কার্টুন করাই যায়। এবং তার আগে সাইটে ঢুকে দেখি ইতিমধ্যে সেখানে মায়ানমারের বেশ কিছু কার্টুনিস্ট কার্টুন পোস্ট করে যাচ্ছে এই মর্মে যে আসলে মায়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন ঘটছে না, বরং ARSA নামের আরাকানি সন্ত্রাসীরাই এটাক করছে। সু কি ষড়যন্ত্রের শিকার। কী আর করা, গণতান্ত্রিক প্লাটফর্মে, সবাই যে যার কথা বলবে। আমরা খালি আমাদেরটা বলতে পারি। তাই প্রকৃত ঘটনার আলকে আমাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে করা কার্টুন সেখানে পোস্ট দিয়ে যাচ্ছি সময় এলেই। আজকে দেখি এই ইস্যুতে দ্বি-পাক্ষিক কার্টুন-লড়াই নিয়ে কার্টুন মুভমেন্ট একটা পোস্ট বানিয়েছে, সবার জন্যে শেয়ার করা গেল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মত জানাতে এটিও একটি ভাল মঞ্চ।http://blog.cartoonmovement.com/…/there-is-more-than-one-tr…


September 15, 2017

বোর্ড বই প্রজেক্ট: 2017

দীর্ঘ দশ মাস পর ২০১৮ সালের বিজ্ঞান বিভাগের নবম-দশম শ্রেণির ৫ টা (গণিত, উচ্চতর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান)  ও আর্টস ও কমার্স বিভাগের একটা (বিজ্ঞান), মোট ৬ টা বইয়ের কাজ শেষ হল। এই মহা-প্রজেক্টের মূল দায়িত্বে ছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার। আর স্যার যখন বলেন যে এটি তাঁর জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ন প্রজেক্ট তখন প্রজেক্টটার গুরুত্ব কিছুটা বোঝা যাবে আশা করি।
বাংলাদেশের বোর্ডের বইয়ের প্রজেক্ট যে কত বিরাট স্কেলের তা বোঝাতে হলে কয়েকটা পরিসংখ্যান জানা জরুরী। এই বই ছাপা হয় মোট ৩৬ কোটি কপি। শুধু নবম-দশম শ্রেণিতেই মোট শিক্ষার্থী ১৫ লক্ষ! এবং এদের সবার হাতে সব জায়গায় বিনামূল্যে এই বই পৌঁছে যেতে হবে জানুয়ারি মাসের এক তারিখে! এটা প্রায় অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার। আমাদের কারো জানামতে বিনামূল্যে এভাবে এত সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক পৃথিবীর আর কোথাও বিলানো হয় না। সেই পাঠ্যপুস্তকের কাজে এবার ডাক পড়েছে আমাদের!

কারোরই ভুলে যাবার কথা না আমাদের পাঠ্যপুস্তকের ইলাস্ট্রেশন আর কন্টেন্টের মানের কী অবস্থা দাঁড়িয়েছিলো। কিছু বই দেখে আমার মনে হয়েছে এতটা অবহেলা নিয়ে যে ছবি আঁকে সে আর যাই হোক শিল্পী নয়। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে এত অবহেলার প্রভাব কি ভয়ানক সেটা ভাবলে আঁতকে উঠতে হয়। ড্রয়িং বা গ্রাফিকাল প্রেজেন্টেশন বইয়েরই অংশ, এবং অনেক গুরুত্বপূর্ন অংশ। সেটা ভাল হলে শিক্ষার্থীরাও ভাল মত বুঝবে ও শিখবে। স্কুলে আমি নিজে খুবি পঁচা ছাত্র ছিলাম, আমি সব কিছুই অনেক দেরীতে বুঝতাম আর সে জন্যে ক্লাসে একটা হাসাহাসিও হত। আমার তখন বেশ রাগ হত, কারণ আমি জানতাম যে এটা বুঝে ফেলছে তার আই কিউ আমার চেয়ে বেশী না। পরে এইচ এস সি তে ওঠার পর আমি একেবারে নিজে নিজে সব বই বুঝে বুঝে পড়া শুরু করি আর তখন আমি আবিষ্কার করি আমাদের বইয়ে সহজ জিনিস গুলি কী কঠিন করে দেয়া আছে। আমি অসংখ্য ডায়াগ্রাম আর চিত্র নিজে বোঝার জন্যে সহজ করে এঁকে নিতাম। এমনকি স্যারদের জিজ্ঞেসও করতাম যে এটা এভাবে না এঁকে এভাবে আঁকলে কি হয় কি না? উত্তর পেতাম- 'বইয়ে যা আছে তাই কর।' বইয়ের প্রতি এই অন্ধ আনুগত্য আর ভুল থাকলেও সেটা মেনে নেবার প্রবণতা দেখলে খুবই বিরক্ত লাগতো। মনে মনে ভাবতাম কখনো যদি এই কাজটা আমি করতে পারতাম।

আমার জীবনের আরো অনেক ঘটনার মতই এবারেও যেটা মনে মনে ভেবেছি সেটা জুটে গেল! ২০১৭ এর জানুয়ারিতে স্বয়ং মুহম্মদ জাফর ইকবাল ফোন দিয়ে বললেন
- টেক্সট বইয়ের ইলাস্ট্রেশন করতে পারবে? সাথে বুক ডিজাইন?

পারবো না মানে? আবেগাপ্লুত হয়ে কী করব বুঝতে না পেরে দুইদিন ঝিম মেরে থাকলাম। তারপর প্রথম মিটিং এ গিয়ে পরে বিশ্বাস হল কাজটা আসলেই করছি।

প্রথম মিটিং জানুয়ারি ২৭, ২০১৭। ইয়াসমীন ম্যাডামের মায়ের বনানীর বাসায় আমরা সবাই।

একই ছবি, খালি আগেরটার ক্যামেরাম্যান হিসেবে থাকা তাম্রলিপির
প্রকাশক রনি ভাই বাদ পড়েছিলেন, উনি এবারে মাঝখানে

এবং প্রথম মিটিং এ আমরা আবিষ্কার করলাম কাজটা এত সহজ না। কারণ এনসিটিবির কাছে কোন বইয়ের সফট কপি নাই! মানে এতদিন যা যা টাইপ করা হয়েছিল তা আবার টাইপ করতে হবে। এবং সেই সাথে তাদের কোন ইউনিকোড বেইজড ফন্ট ও নাই। তার মানে আমাদের এমনকি ফন্ট ও তৈরি করতে হবে। কিন্তু আমি ভুলে যাচ্ছিলাম এই কাজের মূল মানুষটার নাম জাফর ইকবাল। আমাদের কাছে যা অসম্ভবের কাছাকাছি তাঁর কাছে আসলে সেটা খুবই সহজ, কারণ উনি যদি একবার বলেন তাঁর একটা ফন্ট লাগবে, সেটা বানানোর জন্যে অসংখ্য তরুণ ফন্ট নির্মাতা চলে আসবে। এবং সত্যি সত্যি 'অভ্র' খ্যাত সিয়াম রুপালি ফন্টের সিয়াম চলে এসেছে। প্রথম মিটিং এ ফন্ট নিয়ে এত কথা বলার দুটো কারণ।

১. বইগুলি কাজ শেষে ইন্টারনেটে দিলে সেটা ইউনিকোডে না হলে পড়া যাবে না।

২. এনসিটিবির খুবই অদ্ভুত যুক্তাক্ষর রীতির একটা ফন্ট আছে সেটা আর কোথাও নেই, তার মানে আমাদের ঠিক সেটার কপি একটা ইউনিকোড বানাতে হবে।

সিয়াম অসাধ্য সাধন করলো, সেই অদ্ভূত ফন্টের রেপ্লিকা বানিয়ে ফেললো। আর ওদিকে স্যারের সাথে বুয়েটের স্বনামধন্য কায়কোবাদ স্যার মিলে বইয়ের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্য বই সহজবোধ্য/ সুখপাঠ্য করা, ও নির্ভুল করা। তাই লেখকেরা যে আমূল পালটে ফেলবেন সব বই তা হয়নি। কিন্তু যা হয়েছে আমার মনে হয় না এর আগে এনসিটিবির আন্ডারে অন্য কেউ এইটুকু স্বাধীনতাও পেয়েছে। আমরাও আঁকিয়ে হিসেবে ভাগ্যবান। কার্টুনিস্ট মিতু আগেই পাঠ্যবইয়ের কাজে সিদ্ধহস্ত। বেশ কয়েকটা বইয়ের ইলাস্ট্রেশন সে আগে করেছে, কিন্তু সেগুলি ছিল যাকে বলে অন ডিমান্ড। বলে দেয়া থাকবে কী আঁকতে হবে, আর সেটা এঁকে দিতে হবে। এবারের ব্যাপারটা পুরোই আলাদা। পুরো দায় আমাদের মাথায় আর বই গুলো বিজ্ঞান বিভাগের। মানে কোন তথ্যগত ভুল থাকা আবে না। উদাহরণ দেই, হয়ত একটা ড্রয়িং আছে, একটা বাচ্চা ঘুড়ি উড়াচ্ছে। সে এখন যেইভাবে ইচ্ছা ঘুড়ি উড়াতে পারে,  ছাদে-মাঠে-ঘাটে যেখানে ইচ্ছা, ঘুড়িটাও যে কোন রঙ্গে যে কোন ঢঙ্গের হতে পারে। কিন্তু এখানে যেমন আঁকতে হবে কিডনির প্রস্থচ্ছেদ! বোঝো এবার। এবং এই প্রথম আমরা জানতে পারলাম আগের বইয়ে এমনকী আমরাও যা যা পড়ে এসেছি সেগুলিতে বেশ কিছু ভুল আঁকা তো ছিলোই, সাথে ছিলো দুর্বোধ্য এমবিবিএস লেভেলের টেক্সট বই থেকে সরাসরি কপি করা জটিলতম ড্রয়িং, যা ডাক্তার হবেন এমন কেউ ছাড়া কাজে লাগার কোন কারণ নেই। পদার্থবিজ্ঞানের জন্যে আছে স্যার স্বয়ং। এবং তাঁর 'ড্রাফট' করে দেয়া আঁকাগুলি আমাদের ফাইনালের চেয়ে সহজবোধ্য। স্যার তরুণ বয়সে কার্টুন আঁকতেন, এই প্রজেক্টে গিয়ে আবিষ্কার করেছি আঁকাআঁকি নিয়ে তাঁর আইডিয়া খুবই উঁচুমানের, খুবই নিপাট। যাই হোক, আমরা বিপদে পড়লাম জীববিজ্ঞান নিয়ে, গুগল ঘেঁটে আর অন্যান্য টেক্সট বই ঘেঁটে মোটামুটি নামিয়ে দেবার পরে দখা গেল বেশ কিছু ভুল তাও রয়ে গেছে। আমাদের হাতের কাছের ডাক্তার ও পিজি হাসপাতালের শিক্ষক ডা: রোমেন রায়হান- অর্থাৎ কিনা রোমেন ভাই- তাঁর শরণাপন্ন হয়ে বেশ কিছু কনফিউশন কাটলো। ওদিকে কেমিস্ট্রির টেস্টটিউব, পরমাণুর ঘূর্ণন, নল, বিকার ইত্যাদি নির্বিকার চিত্তে এঁকে ফেলছে আসিফ। পদার্থবিজ্ঞানের বোরিং ডায়াগ্রাম ধরিয়ে দিয়েছি কার্টুনিস্ট রোমেলের হাতে। সে আমাকে না করতে পারে না বলে সুযোগ নেয়া। আর এদিকে আমি আর মিতু আমাদের পাশাপাশি চেয়ারে বসে এঁকে চলেছি জীববিজ্ঞান আর বিজ্ঞান বই। সত্যি বলতে আমরা পূর্ণ কাজ করেছি এই দুইটা বইতেই। গণিতের দুই বই কায়কোবাদ স্যার তাঁর টিম নিয়ে করেছেন, সেখানে আমাদের হাত দিতে হয় নি। পদার্থবিজ্ঞানে খালি এঁকেছি, সেটার পেইজ মেকাপও জাফর স্যার নিজে করেছেন। তাঁর যুক্তি ছিল কোথাও কোন লাইন না আঁটলে তিনি ঠাস করে দুই এক লাইন ডিলিট মেরে মিলিয়ে দিতে পারবেন দিতে পারবেন, কারণ সেটা তাঁরই লেখা। আমরা সেটা পারব না। আসলে তিনি আমাদের কাজের প্রেশার কমাতেই এটা বলেছেন সেটা বুঝলেও তাঁর ওপরে আর কথা নেই। দিনের পর দিন এই কাজের ফাঁকে আমি নতুন করে আরেকজনের ভক্ত হয়ে গেছি, তাঁর নাম ড: ইয়াসমীন হক। এমন প্রাণচঞ্চল ভালো মানুষ আমি খুব বেশী দেখিনি।

এই প্রজেক্ট চলাকালীন কতবার ভেবেছি কী কী লিখব প্রজেক্ট শেষে, সত্যি বলতে এখন কেমন খেই হারানো লাগছে। আসলে এত এত ঘটনা এত এত কাজ, কার কথা রেখে কার কথা লিখব। কেমিস্ট্রি বইয়ের অন্যতম লেখক বিদ্যুৎ স্যারের কথা বলব? সেটাই একটা বই হয়ে যাবে। জীববিজ্ঞনের লেখক ড: সৌমিত্রকে নিয়ে বলব? পেইজ মেকাপের জন্যে মাহবুব ভাই কত গুলি ছুটি নষ্ট করে দিনের পর দিন কাজ করেছে তা বলব? আসলে কোনটাই এইটুকু জায়গায় বলা যথেষ্ট হবে না, তাই সেই চেষ্টা বাদ দি'। কাজটা আমরা সময়মত শেষ করতে পেরেছি এটাই বড় কথা। কেমন হয়েছে সেটা শিক্ষার্থীরাই দেখবে, তাদের জন্যে বই সহজবোধ্য হলেই আমরা সার্থক। বই সহজ হলে প্রাইভেট পড়া বা কোচিং যদি কিছুটাও কমে সেটাই প্রাপ্তি। আমাদের মান্ধাতা পদ্ধতির মুখস্থ কেন্দ্রিক পড়াশোনার কালচার যদি কিছুটাও কমে তবেই হল। 

এই কাজে আরেকটা উপলব্ধির কথা বলে শেষ করি। জাফর স্যারের আমি অনেক আগে থেকেই ভক্ত। কিন্তু এই কাজে এসে আমি কিছু জিনিস তাঁর থেকে শিখে আরো বড় ভক্ত হয়ে গেছি। তাঁর অসম্ভব মনের জোর, আর কাজের স্পৃহা। এটা এবনরমাল। উনি সকাল ১০ টায় কাজে বসে টানা রাত ১১ টা পর্যন্ত একইভাবে বসে কাজ করেন, আমি আর মিতু একটু পরেই মোচড়ামুচড়ি শুরু করি কিন্তু তিনি একইভাবে বসা। এবং সেটা একদিন না, মাসের পর মাস! এর মাঝে স্যার আর ম্যাডাম দুইজনেরই পালাক্রমে চিকুনগুনিয়ায় ধরলো। এই ভয়ানক অসুখের মধ্যেও তাঁরা কাজ করেছেন। অবিশ্বাস্য মনের জোর আর ডেডিকেশন না হলে এটা সম্ভব না। 
যাই হোক, পোস্ট আর লম্বা করা যাচ্ছে না, তার চেয়ে বরং কিছু ছবি দেয়া যাক ধারাবাহিকভাবে।



ঢাকা কমিক্সের স্টুডিওতে কাজ চলছে

স্যারের সাথে মিতু

স্যারের সাথে আমি (অনেক কাজ করছি এমন একটা ভাব ধরার চেষ্টা)

স্টুডিও, ডানদিকে মাহবুব চাই, মাঝে আসিফ



অবশেষে কম্পিউটার পৃন্ট করে বইএর ডামি প্রস্তুত। সর্বডানে সময় প্রকাশনীর প্রকাশক ফরিদ ভাই।
ডামি বই বাঁধাই এর গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করে দিয়েছেন।

১২ সেপ্টেম্বর, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে স্যার আমাকে ও মিতুকে বললেন
শিক্ষামন্ত্রীকে বইয়ের সিডি তুলে দিতে। শিক্ষামন্ত্রী শুধু যদি জানতেন
কী পরিমাণ কার্টুন আমরা তাঁকে নিয়ে এঁকেছি!

কাজ শেষে গ্রুপ ছবি। মাহবুব ভাই খালি নাই। ডান থেকে কার্টুনিস্ট রোমেল বড়ুয়া,
কার্টুনিস্ট আসিফ, ইয়াসমীন ম্যাডাম, জাফর স্যার, মিতু, আমি আর সিয়াম

বইগুলির কভার বসিয়ে করা মক-আপ গ্রাফিক্স।

বাঁয়ে আগের ড্রয়িং ডানে আমাদের।

সুন্দর করে দাঁত আঁকার পর স্যার ঘেঁটে দেখলেন কারিকুলামে আছে পরিপাকতন্ত্র, দাঁত তার একটা অংশমাত্র,
কিন্তু বইয়ে আছে অসংখ্য দাঁতের ড্রয়িং আর লেখা, যা না থাকলেও ক্ষতি ছিলো না।
আগের ড্রয়িং এখনকার ড্রয়িং, ব্যপারটা শুধু 'সুন্দর' করা ছিলো না।
আরো যথার্থ ও সহজবোধ্য করাটাই ছিলো চ্যালেঞ্জ। এটা মিতুর আঁকা।

মিতুর আর একটা কাজ। রেফারেন্স হিসেবে যা পাওয়া যায় সেটা আঁকলেই কিন্তু চলছে না,
কারণ সেটায় আবার এতই ডিটেইল থাকে যা আবার এই বইয়ের মূল টেক্সট এ নাই।

আগের ডিএনএ বনাম এখনকার ডিএনএ, এখন বেশী প্রোটিন :P 

আগের বইয়ে শুধু তীর চিহ্নের ডায়াগ্রাম ছিলো, এখন কমপ্লিট করে রক্ত সংবহন বোঝানো হল।
এটা একই সাথে একটা পেইজের উদাহরণ।

ওপরে আগের ড্রয়িং, আর নতুন ড্রয়িং আরো পলিটিক্যালি কারেক্ট করার চেষ্টা

রেশম তৈরির প্রক্রিয়া, আগের ড্রইং ওপরে, আমাদেরটা নীচে

কেমিস্ট্রি বইয়ের আঁকা বাই আসিফ
আসিফের বাত্যাচুল্লী
রোমেল বড়ুয়ার করা পদার্থবিজ্ঞানের ডায়াগ্রাম
বিরাট প্রজেক্ট শেষ হতেই মাথায় এখন রাজ্যের অন্য প্রজেক্ট এসে ঢুকলো। একগাদা কাজ জমে আছে, বইমেলা এল বলে। আপাতত আবার বিদায়। ব্লগে আরেকটু নিয়মিত লেখার আশা রাখি বাকি বছর।

চলছে ফরেন কমিকস