October 23, 2017

বিমূর্ত শিল্পকলা ও আমাদের সংকট


শিল্পাচার্জ জয়নুল আবেদীনের দুর্ভিক্ষ সিরিজ থেকে। ছবির সোর্স

শিল্পী কেন শিল্প তৈরী করেন? এর আসলে কোন সহজ উত্তর নেই। সহজ উত্তর হল- তার ইচ্ছে করে তাই, তার ভালো লাগে তাই, অথবা তার খারাপ লাগে তাই। সোজা কথা কোন তীব্র আবেগ মানুষ নিজে নিজে ধারন করতে পারে না। তার কাউকে বলতে হয়। কাউকে জানাতে হয়। একটা সুন্দর বসন্তবৌরী পাখি প্রথমবারের মত কেউ দেখলে আগে নিজে অভিভূত হবে আর তারপরেই সে চাইবে আশেপাশে আর কাউকে দেখাতে। শিশু যেমন অদ্ভুত কিছু দেখলে সাথে সাথে সেটা আঙ্গুল দিয়ে কাউকে দেখাতে চায়, সেই একই কারণে। এটা অন্যের কাছে আরো উপাদেয় করে তুলতে পারে শিল্পী। শিল্পী মানে কিন্তু আঁকিয়ে বলা হচ্ছে না শুধু। চিত্রকলা, কলাবিদ্যার একটা মাধ্যম মাত্র। সব মাধ্যমেই কথা একই। মূল ব্যাপারটা হল- আমি যেটা দেখেছি বা ভেবেছি সেটার গল্পটা অন্যকে বলা। সেটা গানে, কবিতায়, নাটকে, সিনেমায় যেভাবে হোক বলা চাই।

এবারে ঠিক পরের কথাটাই হল এই বলাটা কে কাকে বলতে চাইছে?  শিল্পী যাকে বলতে চাইছে সে যদি ব্যাপারটা না-ই বোঝে তবে তা বলার মানে থাকে না। ধরা যাক আমি খুব দারুণ একটা চীনা গল্প পড়েছি। আমি চাচ্ছি অন্যেরাও সেটা শুনুক। আমি গল্পটা চাইনিজ ভাষাতেই পড়েছি কারণ আমি চাইনিজ জানি। এখন যেহেতু গল্পটা চাইনিজ আমি সেটা চাইনিজ ভাষাতেই আমার সব বন্ধুদের বললাম। ফলে যেটা হবে সব বন্ধুরা জানবে যে আমি চাইনিজ ভাষা জানি কিন্তু গল্পটা তারা বুঝবে না। তাদেরকে আমার আসলেই সেটা বোঝাতে হলে বলতে হবে তাদের ভাষায়। 

শিল্পের ক্ষেত্রে বিমূর্ত ভাবধারা একটা দারুণ উৎকর্ষ সন্দেহ নেই, কিন্তু যদি কেউ আশা করে সেটা সর্বসাধারণের বোঝা উচিত তবে আমার মতে সেটা এই বন্ধুদের চাইনিজ গল্প বলার মত ঘটনা। যাকে বলছি তার ভাষায় যদি বলা না যায় তবে বলার মানে নেই। তাই শিল্পীকে বলার আগে প্রথমে ভাবতে হবে এটা আমি কাকে বলছি? সবাইকে বলার কিন্তু দরকার নেই, হতে পারে চাইনিজ গল্পটা আমি যারা চীনা ভাষা জানে খালি তাদেরই বলছি। কিন্তু সেটা আগে নিজের কাছে নিজের পরিষ্কার থাকা দরকার। সবাই কেন চাইনিজ বোঝে না সেটা ভেবে সবাই যে আসলে অশিক্ষিত এবং আমি যে এদের থেকে আলাদা এটা বলাটা কতটা হাস্যকর তা আশা করি এই উদাহরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে। 

আমার কাছে মনে হয় আমাদের শিল্পকলায় এরকম দুই মেরু তৈরী হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একটি অতি বিমুর্ত, অন্যটি অতি খেলো। খেলো শিল্প বলতে আমি সেইসব কাজের কথাই বলব যা আসলে শিল্পের তাড়নায় হয় না, হয় শুধুমাত্র অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠতে। বিমূর্ত চিত্রকলা বা শিল্প থাকাটা জরুরী, আর খেলো লাফালাফিও সমাজ থেকে নাই হয়ে যাবে না, সেটা বরং সাময়িক গণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তাও পাবে। কিন্তু এসব বাদ দিয়ে আরেকটা অতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা খালি হয়ে যাচ্ছে সেটা হল- মধ্যপন্থার শিল্প, মানে যা বিমূর্তও না, অকারণে জনপ্রিয় হবার লাফালাফিও না, সেটার ব্যাপক অভাব দেখা যাচ্ছে।  শুধু চিত্রকলা নিয়েই যদি বলি কতিপয় ব্যাতিক্রম ছাড়া আমাদের অসম্ভব গুণী শিল্পীরা কিন্তু চাইনিজ গল্পই বলে যাচ্ছেন, আমরা বুঝতে পারছি না। ইউরোপীয় ভাববাদ ও বিভিন্ন ইজম তাঁরা মধ্যপন্থার বাংলায় ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। আমাদের নিজেদের ইজম গড়ে উঠছে না, আমরা দুর্বল অনুবাদেই আটকে আছি। একই সাথে চিত্রকলায় পপুলার ধারা শীর্ণ হয়ে আসছে। সমসাময়িক সমাজ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে শিল্পীরা কাজ করছেন না তা নয়, কিন্তু সেটা কেন জানি সুখপাঠ্য হচ্ছে না। দুর্বোধ্য সংকেতের মারপ্যাঁচে তা তাদের নিজেদের বৈঠকখানার চায়ের কাপেই আটকে যাচ্ছেন, মডার্নিজম পার হয়ে পোস্ট মডার্নিজম চলে যাচ্ছে, আমরা আমজনতা যেই তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছি। একটা বড় শিল্পীগোষ্ঠী ইউরোপমুখী যশাক্রান্ত বিধায় দেশের মানুষদের মূর্খ ভাবছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল প্রতিটা দেশই আলাদা, তার নিজস্ব একটা ইতিহাস থাকে, থাকে নিজস্ব দৃশ্য-ভাষা। সবাই চেনে ও জানে এমন ভাষায় না বলে আমি বাইরের ভাষায় বলে আশা করতে পারি না সবাই বুঝবে, এবং ইউরোপীয় দর্শন জানি না বলে আমি ততটা মূর্খ না যতটা সেই শিল্পী তার নিজের দেশের দর্শন না জেনে হচ্ছেন। 

এখন এ তো গেল সংকটের কথা, সমাধান কী? সমাধান এক কথায় বলা সহজ না, তবে যে কারণে এই লেখার অবতারণা সেটা হল- এই মুহূর্তে অসম্ভব প্রতিভাবান আঁকিয়ে ও শিল্পীর দারুণ একটা জাগরণ ঘটছে আমাদের দেশে। তাঁরা আঁকছেন, গাইছেন, শিল্প সৃষ্টি করছেন। তাঁরা তাঁদের উচ্চমার্গীয় বোধে আঁকুন সমস্যা নেই কিন্তু আমাদের নিজেদের ভাষার আঁকিয়েও খুব দরকার। যার গল্পটা বাংলায় বলা, যার গল্প বলে আসলেই কিছু আছে। শুধু আমি কতটা ভাল কাজ করি এটা দেখানোই উদ্দেশ্য না। আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যও থাকতে হবে সাথে। যা সবাইকে ভাবাবে ও একটা জীবনদর্শন দেবে। 'জনমানুষের জন্যে শিল্পই একমাত্র সার্থক শিল্প' এমন না হলেও জনমানুষের শিল্প সবচেয়ে প্রয়োজনীয় শিল্প বটেই। 

তাই শিল্পীদের আঁকা উচিত প্রথমে নিজেদের জন্যে তারপরেই নিজেদের আশাপাশের সবার জন্য। যাকে পাশে তাকালেই দেখা যায়। যাকে আঙ্গুল উঁচিয়ে দূরের বসন্তবৌরী দেখিয়ে বলা যায়। ইউরোপের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করলে সেটা অতদূরে না-ও পৌঁছাতে পারে। আর কোনভাবে পৌঁছালে দেখা যেতে পারে এরকম পাখি তারা ১০০ বছর আগেই ঢের দেখেছে। তাই পা নিজের মাটিতে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।

No comments:

Post a Comment

হ্যাংওভার কাটিয়ে

একটা সময় ছিল সব জায়গায় লেখা থাকতো (অবশ্যই এখনো আছে) 'রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ'। এখন অবস্থা উলটো। এখন যেন রাজনীতি ছাড়া অন্য আলাপ জমেই না। ...