গত বছর (জুলাই ১১- ১৪, ২০০৯) কার্টুনিস্ট হিসেবে ইরান সরকারের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দেবার আমার এক বিরল সৌভাগ্য হয়েছিলো। সেই ইরান তুরান পার হবার সচিত্র বিবরণ উন্মাদে ছাপা হয়েছিলো। তারপরেও অনেকে সেটা পড়তে পারেননি বলে অনুযোগ করেছেন। সেগুলো ভেবে ল্যাখাটা হুবহু এখানে তুলে দিলাম
ঘুরে এলাম গুলিস্তান
খুব সম্ভব ২০০৫ সাল। ইরান কালচারাল সেন্টার থেকে উন্মাদ অফিসে একদিন একটা আমন্ত্রণপত্র এলো। কার্টুনের ওপর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হবে। আমরা কিছুটা অবাক হলাম। ইরানকে আমরা জানি গোঁড়া ধার্মিক এক মুসলিম দেশ। তারা কার্টুন নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছে। ব্যাপার জানতে উন্মাদ থেকে চারজনের একটা টিম পাঠানো হল। খুব স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে ছিলেন মাত্র দু’জন কার্টুনিস্ট। কিশোর ভাই আর তন্ময়। আর অন্য দিকে উন্মাদের আইডিয়াবাজ (কাম বাংলাদেশের সব পত্রিকার কন্ট্রিবিউটার) মারুফ সাথে হুয়াওয়ে টেলিকমের কর্মকর্তা তানিম ভাই। বলা বাহুল্য মিটিং এ মারুফ ও তানিম ভাই-ই কার্টুন সম্পর্কিত যাবতীয় আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে অফিসে এসে কিশোর ভাই গম্ভীর স্বরে বললেন, “আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে - কারণ অনেক রকম ফল খেতে দেয়া হয়েছে।” ইরানের কার্টুন সম্পর্কিত জ্ঞান আমাদের ওই পর্যন-ই। (ঐ সময়টাতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল চলছিলো বলে আমি যেতে পারিনি) ওই ফলপ্রসূ আলোচনার প্রায় তিন বছর পর হঠাৎ উন্মাদ অফিসে আবার ফোন আসে। কি ব্যাপার? না - এবার ইরান সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তরুণ শিল্পীদেরকে রাষ্ট্রীয় খরচে ইরানে নিয়ে যাবে। ১০ দিনের সরকারী সফর থাকা খাওয়া যাতায়াত ফ্রি! শুনেই আমরা সবাই নড়েচড়ে বসলাম। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল মোট পাঁচটা ক্যাটাগরীর মধ্যে কার্টুনও আছে আর অংশগ্রহণকারীর বয়স মোটামুটিভাবে ২৫ এর মধ্যে হতে হবে। আমার কানের পাশ দিয়ে গুলি গেল। আর একমাস এদিক ওদিক হলেই হয়ত আর কাজ জমা দেয়া যেত না। যাই হোক আমরা আমাদের কার্টুনের নরম ও শক্ত ( hard & soft) ভার্সন ইরান কালচারাল সেন্টারে জমা দিয়ে এলাম। সপ্তাখানেকের মধ্যে জানানো হলো বাংলাদেশ থেকে দু’জন কার্টুনিষ্ট নির্বাচিত হয়েছে। একজন আমি আর একজন কে তারা বলতে পারছে না। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত কারণ আমি ফোন করে সম্ভাব্য অন্য সবার নাম তালিকা ধরে বলে গেলেও তারা বারবারই বলে - “না, না, এ না” ফ্লাইটের দুদিন আগে তারা জানালো অন্যজনের নাম রাশাদ ইমাম অর্থাৎ আমাদের তন্ময় । এটা জানতে এতদিন কেন লাগল তা বোঝা গেল না। যাই হোক তন্ময় আমার সাথে নির্বাচিত হওয়ায় ওর চেয়ে আমি বেশী খুশি হই, কারণ আমার বিদেশ ভীতি আছে। কোন দুর ইরান দেশে জানি না টানি না কে জানে কোন ধরনের লোকজন সেখানে থাকে। এর পরের কাজকর্ম বেশ দ্রুত এগুলো, একদিনের মধ্যে টিকিট ও ভিসা হয়ে গেল । আমরা আমাদের বাংলাদেশ টিমের অন্য দু’জন মেম্বারের সাথেও পরিচিত হলাম। তারা দুজনেই চারুকলার স্টুডেন্ট - ফরহাদউদ্দীন মাসুম, ও মারজিয়া । কথাবার্তা বলে দুজনকেই বেশ পছন্দ হলো। মনে হলো ইরান সফর খারাপ হবে না।
জিয়া থেকে তেহরান এয়ারপোর্ট
৭ই জুলাই ২০০৯। সকাল ১১.৩০ এ আমরা Emirates -এর দুবাইগামী ফ্লাইট এ উঠলাম। প্লেনে উঠে জানতে পেলাম এ টিমে একমাত্র আমারই এটা প্রথম বিদেশ যাত্রা। কোন একদিন মেঘের মধ্য দিয়ে যাব এমন একটা স্বপ্ন সবসময় দেখতাম। কিন' সেটা যে কার্টুন আঁকার সুবাদে পূরণ হবে তা কখনো ভাবিনি। তবে প্লেনের ভ্রমণটা অত আহামরি লাগেনি। কিছু বুঝে উঠবার আগেই সেটা মেঘের ওপরে উঠে যায় আর তারপর থেকে নীচে খালি সাদা মেঘের স-র। আষাঢ়ের মাঝামাঝি বাংলাদেশের ওপর থেকে মেঘ ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না। তন্ময় জানালো প্রথমবার সে আরেকভাবে হতাশ হয়েছিল। তার আশা ছিল প্লেনের কমোড ট্রেনের কমোডের মতোই হবে। ঢাকনা খুললেই নীচে মেঘ দেখা যাবে। মেঘ দেখতে দেখতে আমার মাথায় কালিদাস নড়াচড়া করতে শুরু করলেন। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে মেঘদূত থেকে দু’ এক লাইন আওড়াব কিনা ভাবছি এমন সময় খেয়াল করলাম এমিরেটসের Ramp মডেল সদৃশ এয়ার হোস্টেসরা লাঞ্চের মেন্যু নিয়ে আসছেন। মাথা থেকে মেঘদূত উধাও হল।
এমিরেটসের ফ্লাইট EK583Y চার ঘন্টার মধ্যে আমাদের নিয়ে দুবাই এয়ারপোর্টে ল্যাণ্ড করল। দুবাইএ নেমে মনে মনে দু’বার ‘খাইছেরে’ বললাম। মোটামুটি এলাহী কারবার। এই এত এত দেশের কয়েক হাজার যাত্রীদের মধ্যে আমরা নিজেদের তেহরানগামী ফ্লাইট খুঁজে ফিরতে পারব এমনটা আমার বিশ্বাস হল না। মাসুম ভাই জানালেন তার টম হ্যাংকস এর টার্মিনাল মুভিটা দেখা আছে, সুতরাং তিনি ভয় পান না।
শেষ পর্যন্ত দুবাই এয়ারপোর্টের ভুলভুলাইয়া সদৃশ করিডোর তস্য করিডোর পার হয়ে আমরা আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গেট খুঁজে বের করলাম এবং আমাদের জন্য এমিরেটস কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লাঞ্চও খেয়ে নিলাম। হাতে আরো ঘন্টা খানেক সময় থাকায় আমরা চারদিক ঘুরে দেখতে থাকলাম। এ সময় আমরা দু’টো মর্মান্তিক ব্যপার আবিষ্কার করি।
১.দুবাই এয়ারপোর্টে টয়লেট আর মসজিদ একই সাইনবোর্ডে লেখা আর সে দু’টা আলাদা করাই দুঃসাধ্য (তন্ময় বাথরুম মনে করে মসজিদে ঢুকে পড়েছিল।)
২.দুবাই এয়ারপোর্টে যে ক’জন বাঙালী পাওয়া গেল তারা আসলে টয়লেট ক্লিনার। প্রায় সব ক’জন টয়লেট ক্লিনার বাংলাদেশী।
সবশেষে আমরা নির্দিষ্ট সময়ে তেহরানগামী ফ্লাইটে উঠে বসলাম। আর মাত্র দুই ঘন্টা তারপরই আমরা ইরান পৌঁছে যাব। রহস্যময় পারস্য, শাহনামার ইরান । সুফিবাদের জন্মস্থান, আরব্য রজনীর ইন্দ্রজালে ঘেরা পারস্যে যাচ্ছি। রাজা দারিয়ুসের মরদেহ কি এখনো সেখানে আছে? জারেক্সেসের ক্লে ট্যাবলেট কি দেখতে পাব? পার্সেপোলিসের সেটয়ারকেস? নিওলিথিক যুগের মানুষ - এসব কি ওদের মিউজিয়ামে আছে ? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম।
তেহরানে কবি ফেরদৌসীর সাথে
ঢাকার ইরান কালচারাল সেন্টার থেকে আমাদের বলা হয়েছিল যে তেহরান এয়ারপোর্টে আমাদের রিসিভ করবেন একজন দোভাষী মহিলা - ‘মিসেস ফামুরী’ আমাদেরকে তাঁর ফোন নাম্বারও দিয়ে দেয়া হয়েছে। এয়ারপোর্টে নেমে আমরা আমাদের কল্পনার সাথে মেলে এমন ফা’মুরি টাইপ মহিলা খুঁজতে লাগলাম। প্রায় মিনিট দশেক খুঁজেও যখন পেলাম না তখন হঠাৎ তন্ময় খেয়াল করল এক পক্ক কেশ শ্বেতগুম্ফ লম্বা ভদ্রলোক আমাদের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে বিরক্তমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ইনিই মিসেস ফা’মুরি! পরে আমরা জানতে পারি ওই নামে কোন মহিলার কথা কেউ জানে না। এই ভদ্রলোকের নাম মি. নমিনী। বিভিন্ন দেশের তরুণ শিল্পীদের অভ্যর্থনা জানিয়ে হোটেলে নিয়ে যাবার দায়িত্ব এনার ওপর পড়েছে। ভদ্রলোকের বিরক্তির কারণও আমরা পরে জানতে পেরেছিলাম। সেটাও বলছি।
মাইক্রোবাসে উঠে চার বাংলাদেশী হা-ক্লান্ত হয়ে রাতের তেহরান দেখবার বদলে চোখ বুজে ঝিমানো শুরু করলাম - কখন হোটেল আসবে। পরে ঘন্টাখানেকের জার্নির পর আমরা সে হোটেলের সামনে পৌঁছলাম সেটার নাম ‘ফেরদৌসী গ্র্যান্ড হোটেল’ হোটেল দেখে সবাই ধাক্কা খেলাম-আমরা এইখানে থাকব? এটা তো রীতিমত আমাদের সোনারগাঁ। পরে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম এটা তেহরানের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী চার তারা হোটেল। তবে সেটা ছিল আমাদের বিস্ময়ের শুরু। আমাদেরকে যার যার রুম বুঝিয়ে দেয়া হল। রুমের ব্যাপারে দু’টো কথা বলে নেই। আপনারা কেউ যদি কখনো ইরানে যান এবং সেখানকার হোটেলে থাকেন তবে এগুলো কাজে লাগবে।
১। যদি দেখেন সব সুইচ অন্ করা তবে সেটা অফ করে দেবেন। লাইট ফ্যান সব চালু হয়ে যাবে। ইরানে সুইচ উল্টা দিকে অন্ হয়।
২। রুমে বিরাট এয়ার কন্ডিশন সদৃশ যে জিনিসটা ওখানকার হোটেলে দেখতে পাবেন সেটা আসলে একটা রেডিও। প্রথমদিন এসি মনে করে আমরা সেটা ছাড়তেই ফার্সী গান শুরু হয়।
ইরানে অবশ্য আরো অনেক কিছুই উল্টো। আমাদের রাস্তা ঘাটে আমরা যেমন, ‘যার যার বাঁয়ে’ নীতিতে চলে ওরা চলে, ‘যার যার ডানে’ ফলে রাস্তা পার হতে গেলে আগে এখানে বামে তাকাতে হয় পরে ডানে। আর ফার্সী ভাষা আরবী হরফে ও আরবী স্টাইলে ডান থেকে বামে লেখা হয়। দিন দু’য়েকের মধ্যেই অবশ্য আমরা এটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম শুধু গোল বাঁধল খেতে গিয়ে।
ইরানীরা যে খাবার বেলাতেও বেশ ধার্মিক সেটা আমরা প্রথম রাতেই টের পেলাম। এক্ষেত্রে-- তারা তাওহীদ এর ধারণায় বিশ্বাসী। এক খোদার (খোদা ফারসী শব্দ) মত তারাও এক মাছ ও এক মুরগী তে বিশ্বাসী। আমরা যদি একটা মাছ এর অর্ডার দেই তবে আক্ষরিক অর্থেই গোটা একটা মাছ এসে পড়ে। এক মুরগী মানে আস্ত একটা মুরগী (ভাগ্যে আমরা কেউ এক গরু অর্ডার দেই নি।) সোজা কথা এক জনের জন্যে যে খাবার আসে সেটা আমরা মন কষা কষি না করেও নিশ্চিন্তে তিনজনে খেতে পারব। প্রায় প্রতিদিনই আমরা পাতে খাবার ফেলতে শুরু করি। শেষের দিকে অবশ্য এক প্লেট দু’জন ভাগ করে খাবার মত সহজ বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিল। খাবার অর্ডার দিতে গিয়ে শুরু হয় আরেক বিপদ। গোটা হোটেলের বয় বেয়ারারা সাকুল্যে দু’টো ইংরেজি শব্দ জানে আর সেটা হল, ‘NO ENGLISH’ মুরগী অর্ডার দিতে গিয়ে তন্ময় অনেক্ষণ চিকেন, বার্ড, হেন ইত্যাদি বলে শেষে মুখে কক্ কক্ করে ডানা ঝাপটানো শুরু করল। বেয়ারা সেটা দেখেও দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে থাকে। অবশেষ আমরা শিল্পাচার্য পদ্ধতিতে এগোই। শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন ভিনদেশে গিয়ে হাতে এঁকে কি খাবেন তার অর্ডার দিয়েছিলেন। ড্রয়িং করে যে আসলেই পেটের ভাত যোগাড় করা যায় সেটা প্রমাণিত হল। যার যার Sketch বুকে আমরা এঁকে দেখালাম কি খেতে চাচ্ছি। এবারে কাজ হয়।
অপ্রত্যাশিত
দ্বিতীয় দিন উঠে আমরা জানতে পেলাম আজ আমাদের তেমন কোন কাজ নেই শুধু ঘোরাঘুরি। ঘোরাঘুরির অংশ হিসেবে প্রথমে যাব Contemporary art Museum এ আর বিকেলে যাব ‘জামশেদি পার্ক’ নামের একটা পার্কে। উল্লেখ্য আমাদের এই গোটা সফর (সফর ফার্সী শব্দ) Contemporary art Museum এর তত্ত্বাবধানেই হচ্ছে। ফেরদৌসি হোটেল থেকে মিনিট তিরিশের বাস জার্নি করে তেহরানের Contemporary art Museum এ পৌঁছানো গেল। ছিমছাম একতলা একটা বিল্ডিং। আমরা কিছু মর্ডান আর্টওয়ার্ক দেখব বলে সেটার দরজা দিয়ে ঢুকলাম। তারপরেই বিস্ময়ে চোখ মাথার তালুতে উঠে গেল। এখানে যাদের মূল চিত্রকর্ম রাখা আছে তাদের কয়েকজনের নাম শুনলেই সেটার কারণ বোঝা যাবে। এখানে যাদের কাজ রাখা আছে তাদের নাম হল পাবলো পিকাসো, ভিনসেন্ট ভ্যান গঁঘ, ক্লদ মানে, কামিল পিসারো, সালভাদর দালি, জর্জ ব্রেইক, হেনরি মুর, পল সাজান, এদগার দেগা, জোয়ান মিরো, জ্যাকসন পোলক, রেঁনে মাগ্রিটে ... আমার মডার্ন আর্ট সম্পর্কে দৌড় হল উইকিপিডিয়ার আর্টিকেল। সেগুলো থেকেই ধারণা করতে পারছিলাম আধুনিক চিত্রকলার দিকপালদের কাজ দেখতে পাচ্ছি যা ইউরোপ ছাড়া অন্য কোথাও একসাথে এতগুলো থাকবার কথা নয়। শেষকালে খোমেনীর দেশ ইরানে এসে পিকাসো-দালির ছবি দেখব এটা কখনো কল্পনা করিনি। আমি আঁকি কার্টুন- আমারই ছবিগুলো দেখে বাক্যহারা অবসস্থা ওদিকে পেইন্টার হিসেবে যারা এসেছে তারা তো রীতিমত আহা উহু শুরু করে দিয়েছে। মারজিয়া একের পর এক ছবি তুলছেন মাসুম ভাই মাথার হাত দিয়ে দাত মুখে খিঁচে টাইটেল পড়ে যাচ্ছেন। পাকিস্তানি জোহরা (ভাল কথা, অন্য কারো নাম বলাই হয়নি এতক্ষণ। দ্বিতীয় দিন এ আমাদের সাথে এসে বিভিন্ন দেশের আরো প্রায় দশ জন প্রতিযোগী শিল্পী এসে যোগ দেয়, আশা করি কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সবার কথা বলা হয়ে যাবে) জ্যাকসন পোলকের ছবিটার সামনে দাড়িয়ে বিড়বিড় করছে, ‘ ম্যাড্, ম্যাড্’। মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছু চমৎকার তথ্য দিলো। প্রথমতঃ আমরা যেদিন মিউজিয়ামে যাই সেদিন থেকেই এই মিউজিয়ামে জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়। ওইদিন আসলে ছুটির দিন ছিল, মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ বিশেষ ব্যবস্থায় সেটা আমাদের জন্যে খুলে দেবার ব্যবস্থা করেন। আর দ্বিতীয়তঃ মিউজিয়ামে ছবি তোলা নিষেধ হলেও আমাদের প্রতি সৌজন্যবশত ছবি তুলবার অনুমিত দেয়া হয়েছে। মাস্টারদের এইসব ছবি দেখতে দেখতে তন্ময় কাছে এসে ফিসফিস করে বলে ‘বস আমাদের ছবি দুইটা এক কোনা দিয়া ঝুলাই দেই চলেন’, বাহ আইডিয়া খারাপ না। আমরা প্রত্যেকেই যার যার পোর্টফোলিও আর কাজের দু’টো করে স্যাম্পল ফ্রেম নিয়ে ঘুরছি। এক ফাঁকে এখানে ঝুলিয়ে দিতে পারলে মন্দ হয় না।
দ্যা পাথ, ও সিরামিকের বাটি
বিকেলে আমাদের যে জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল সেটার পোশাকী- নাম, ‘জামশেদী পার্ক’। এটার আরেকটা নাম হল ‘চঅঞঐ' বাংলায়- ‘পথ’ পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে সোজা একটা পথ ধাপে ধাপে ওপরে উঠে গেছে, জায়গায় জায়গায় বসবার ব্যবস্থা, হঠাৎ একটা ছোট্ট পুকুর। ওপরের সারি সারি ‘চেনার’ ও ‘খাজ’ বৃক্ষ থেকে মাঝে মাঝে দু’একটা পাতা খসে পড়ছে। অদ্ভুৎ শান্ত সুন্দর একটা জায়গা। একটু পর পরই কিছু ইরানী পরিবারকে তাঁবু খাঁটিয়ে পিকনিকরত অবস্থায় দেখতে পেলাম। এ ব্যাপারটা ইরানের সব জায়গায় দেখেছি। কোন সুন্দর জায়গা পেলেই এরা তাঁবু খাঁটিয়ে পুরো গুষ্টি একসাথে রান্নাবান্না করে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয়। পরিবার নিয়ে একসাথে ঘোরাফেরাটা এদের একেবারে হাড় মজ্জায় মিশে আছে। এই জাতি যে কয়েক হাজার বছর আগে যাযাবর জীবন যাপন করত তা এগুলো দেখে বিশ্বাস হয়। যাই হোক ‘পাথ’ বা ‘পথ’ নামের ওই পাহাড়ী রাস্তার চুড়োয় গিয়ে আমরা আরেকবার চমৎকৃত হই। কাঠ আর পাথর দিয়ে সেখানে এক সুন্দর কাফে বানানো। অদৃশ্য কোন মিউজিক প্লেয়ার থেকে ফার্সি গান ভেসে আসছে। কাফেতে খাবার দাবারের আয়োজন বেশ অন্যরকম, কিছু কাঠের চৌকি পেতে রাখা যাতে বালিশে আধশোয়া হয়ে দিব্যি জমিদার বিশ্বম্ভর বনে যাওয়া যায়। না চাইতেই এরপর চলে আসবে একের পর এক খুরমা, খেজুর, খোশবাই ওয়ালা রং চা, মিসরির দানা। আর সেই সাথে হুঁকোমতন দেখতে সুগন্ধী ধুম্রবাহী শীসা, ক’দিন আগে ঢাকায় উঠিত ছেলেমেয়েরা সেই জিনিসটা নির্দোষ ধোঁয়া ভেবে সমানে খাচ্ছিল সেই জিনিস। সিনটা এখানে খুবই অদ্ভুত লাগল যখন দেখলাম বোরকা পরা মহিলারা বালিশে হেলান দিয়ে গুরুতর ভঙ্গীতে আরেকজনের সাথে কথা বলছে আর থেকে থেকে হুঁকোয় টানদিয়ে মুখ থেকে ধোঁয়া ছাড়ছে। এখানে ইরানী তরুণীদের ব্যাপারে দু’টো কথা না বললেই না। এরা অপ্রত্যাশিত রকমের আধুনিক স্মার্ট। চাল চলনে কথাবার্তায় অত্যন- সাবলীল, ন্যাকামীর বালাই নেই, গাড়ী ড্রাইভ করে নিশ্চিনে- এক প্রভিন্স থেকে আরেক প্রভিন্স এ চলে যাচ্ছে। এরা শালীনতার সাথে গোঁড়ামিটা গুলিয়ে ফেলেনি। তবে নতুন প্রজন্মের তরুণ তরুনীদের আরেকটা ব্যাপার দেখে আমরা অবাক হয়েছি, প্রচুর ছেলেমেয়েদের নাকে ব্যান্ডেজ। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করাতে বলা হল- প্লাস্টিক সার্জারি। জন্মগতভাবে ইরানীদের নাক খাড়া, তারা হাল ফ্যাশনের অংশ হিসেবে সেটাকে কেটে ছেটে ভোঁতা করে ফেলেছে। ব্যাপারটা আমাদের একদম পছন্দ হয়নি। একটা জন্মগত নাক উঁচু জাতি ইচ্ছে করে নাক ছোট করে ফেলেছে- কোন মানে হয়? (আমি অবশ্য গোপনে খোঁজ নিয়েছিলাম যে উল্টোটা করা যায় নাকি। এই চান্সে যদি অস্ট্রিক দ্রাবিড়ের বংশধরদের ভোঁতা নাকটা উঁচু করা যায় খারাপ কি? কিন' সে রকম করার নাকি উপায় নেই।)
এইবার আমাদের গোটা দলটার একটা ছোট পরিচয় দিয়ে নেই। প্রথমে দেশ। মোট ১১ টা দেশ এই প্রোগ্রামে অংশ সেনেগাল, কেনিয়া ও চীন। জার্মানি ও ইন্ডিয়া থেকে শেষ মূহুর্তে কেউ আসেনি। এত এত দেশ থেকে কার্টুনিস্ট কিন' এসেছে আমাদের সহ মাত্র ৫ জন। পাকিস্তান থেকে সানা নাসের, আজারবাইন থেকে তোরাল হাসান আর আফগানিস্তান থেকে মেহেদী আমিনী (হ্যাঁ ভাই পৃথিবীতে আমিই একমাত্র মেহেদী নই, ইরানে যাবার পর নিজেকে অনেকটা জেব্রা জেব্রা মনে হয়েছে। চারদিকে গন্ডায় গন্ডায় মেহেদী।) এই আফগানিস্তানী কার্টুনিস্ট আবার পেশায় সরকারী স্থপতি। পরে প্রতিযোগীতায় এর কাজ দেখে আমরা মুগ্ধ হই। এছাড়া বাকী সবাই হয় পেইন্টার, গ্রাফিক ডিজাইনার নয়তো স্কাল্পটর। মিনিয়েচার এবং ক্যালিগ্রাফী বিভাগে কেউ আসেনি। দলের সদস্যদের ব্যাপারে বলার মাঝে বলে নেই, আমাদের ফ্লাইটের আগের দিন আমি আর তন্ময় যখন নীলক্ষেতে আমাদের পোর্টফোলিও বাঁধাই করছিলাম তখন দু’জন একটা ব্যাপার ঠিক করি। বাইরের পোলাপান যদি সামান্য ‘ভাব’ দেখায় তবে আমরাও ভাবের চূড়ান- দেখিয়ে ছাড়ব। ভাব কত প্রকার ও কি কি তা উদাহরণ সহ বুঝিয়ে দেব। কিন' অন্যান্য দেশ থেকে আশা আমাদের সমবয়সী এই একদল ছেলেমেয়ে আমাদের সেই সুযোগ দেয় নি। সত্যি বলতে ফিরে আসবার আমরা ভেবেছি একসাথে এতগুলো সমমনা ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা বন্ধুচক্র কি আর কখনো পাব? এই প্রথম আমরা আবিষ্কার করেছি যে একেকজনের ভাষা একেক রকম হলেও একটা ভাষায় আমরা সবাই যোগাযোগ করতে পারছি সেটা হল আর্ট, সঠিক প্রতিশব্দ না জানলেও আঁকাআঁকি ও গ্রাফিক ডিজাইনিং এর মূল ব্যাকরণগুলো আমরা ঠিকই একে অন্যের সাথে বিনিময় করে যাচ্ছিলাম। এ ক’দিন আমাদের সবচেয়ে বেশী বন্ধুত্ব হয়ে যায় কেনিয়ার হাসান (এর সাথে সবচেয়ে বেশি খাতির হয় আমার, কারণ এর পাশে দাঁড়ালে আমাকে মনে হত উজ্জ্বল শ্যামলা) আর পাকিস্তানী পাঁচজনের সাথে। প্রথমে আমরা বাংলাদেশীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটা যুদ্ধংদেহী ভাব নিয়ে ওদের সাথে কথাবার্তা শুরু করলেও একটু পরেই সেটা ধরে রাখতে ব্যার্থ হই। পাকিস্তানী আহমেদ যেভাবে হেসে ‘আবে ইয়ার’ বলে জড়িয়ে ধরে তার পর আর কঠিন দৃষ্টি ধরে রাখা সম্ভব না। পাকিস্তানী ফাতিমা তো পুরো দলটাকেই হাসাতে হাসাতে প্রায় মেরে ফেলেছিলো, আহমেদের আরো দুই ক্লাসমেট মাহ্বিশ আর সানা পুরো ইরানী যুবকদের হৃদয় ঝড় তুলতে তুলতে সফর শেষ করে। এটা একটা ভালো অভিজ্ঞতা বলা যায়। আমরা ইরান জার্নির পর Aesthetic এর সংজ্ঞা আবার নতুন করে বুঝলাম। ইরানের কোন হোটেলের বয় বেয়ারাও হলিউডের যে কোন হিরোকে ডাউন দিয়ে দিবে। মেয়েদের মধ্যে চোখ বুঁজে অবু দশ বিশ করে কাউকে বাছলেও দেখা যাবে সে বলিউডের সিনেমায় নায়িকা হবার যোগ্য। আর এ কারণেই এখানে সুন্দর ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। মাসুম ভাই প্রথম প্রশ্নটা করেন যে এরা সিনেমার জন্য নায়ক নায়িকা কিভাবে বাছে? আসলেই এরা সবাই এত সুন্দর যে আসলে কেউই সুন্দর না। মানে হল কাউকে আলাদাভাবে সুন্দর বলাটা কষ্টকর। আর এ কারণেই পাকিস্তানী- একটু বাদামী- মেয়েদুটো যেখানেই যাচ্ছিলো সেখানেই ইরানী ছেলেগুলো হা করে তাকিয়ে থাকছিলো। আমাদের সাথে আরো ছিল আলবেনিয়ান তিনজন। মোহাম্মদ সাদিক, এভিস ও এলটন। প্রথমজনের নাম শুনে পুরোপুরি একটা ভুল ধারণা হতে পারে, বাস-বে সাদিক সাহেব একজন ব্রুস উইলিস লুক এলাইক। তিনি আলবেনিয়ার ফাইন আর্টস কলেজের ভাস্কর্য বিভাগের একজন অধ্যাপক। তার ছাত্র এভিসকে নিয়ে এসেছেন। এভিস এর শরীর স্বাস্থ্য দেখে প্রথমে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম ব্যাটা বয়স ভাঁড়িয়ে এসেছে। এ কোন মতেই আন্ডার টুয়েন্টি ফাইভ না। কিন্তু কিমাশ্চর্যম! ব্যাটার বয়স নাকি মাত্র বিশ। ওই ছয়ফুটি শোয়ার্যনিগারের মাসতুতো ভাইয়ের বয়স যদি বিশ হয় তবে আমরা তো জন্মাইনি। তাকে আমরা অবশ্য পুরো জার্নিতে বারবার জ্বালাতন করলাম ওই বয়স নিয়ে। মাঝে মাঝেই বলতাম- ‘এভি উই ডোন্ট থিংক দ্যাট ইউ আর অনলি টুয়েন্টি, বি অনেস্ট’ এটা বলবার সাথে সাথেই এভিস কাঁদো কাঁদো স্বরে ফর্সা মুখটা লাল মরিচের মত করে তার আইডি বের করে আমাদের দেখায়। ‘সি? সি? আই এম অনলি টুয়েন্টি’ ওর এই অভিমান ভরা গলা শুনে আমাদের অবশ্য তখন আর কোন সন্দেহ থাকে না যে ছোকরা আসলেই বাচ্চা। আমরা অবশ্য তারপরও ছাড়ি না, ভালো করে আইডি দেখে বলি- ‘বাট ইট সিমস লাইক এন অর্ডিনারি কম্পিউটার প্রিন্ট’- ছোকরার ফিগার দেখে অবশ্য কথাবার্তা আর বেশি বাড়ানোর সাহস হয় না।
জামশেদী পার্ক পর্বের পরের দিন আমরা দলবল বেঁধে ইরানের আরেক প্রদেশে রওনা দিলাম। বলা হল সেই প্রদেশ ইরানের প্রাচীনতম-প্রায় সাত হাজার বছর আগের এলাকা এবং ওই এলাকা থেকেই ইরানের পৃথিবী বিখ্যাত সিরামিক শিল্পের বিকাশ। প্রদেশটার নাম ‘সেমনান’, আমরা যেদিন সেমনানে পৌছলাম সেদিন সেখানে ইরানের সমসাময়িক সিরামিক শিল্পীদের কাজের একটা প্রদর্শনীর ক্লোজিং সেরিমনি চলছিল। আমাদেরকে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত গাইড মিঃ আহমদ বললেন ‘দ্যাট উইল বি ভেরি ইন্টারেস্টিং’। সিরামিকের মধ্যে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা আবার কি সেটা বোঝা গেল না। আমরা জানি সিরামিকের হয় প্লেট, কাপ পিরিচ, বড়জোর সেগুলোতে যেসব খাবার পরিবেশন করা হয় সেগুলো ইন্টারেস্টিং হতে পারে। সেমিনার শুরু হতে আমাদের ভুল ভাঙ্গলো। সিরামিকের প্রদর্শনী দেখতে লোকে লোকারণ্য । আসলে এই প্রদেশে সিরামিক শিল্পকে খুবই সম্মানের চোখে দেখা হয়, এখানের ইতিহাস আসলে অনেকটাই সিরামিক শিল্পের ইতিহাস। কিন' আমাদের যাদের জ্ঞান বড় জোর সিরামিকের কাপ আর বাটি পর্যন- তাদের কাছে ব্যাপারটা রীতিমত অত্যাচার বলে মনে হল। তাও যদি তাদের কোন কথা বুঝতাম। ঝাড়া দুই ঘন্টা ধরে আমাদের গোটা দশেক সিরামিক বোদ্ধাদের ফার্সী বক্তৃতা শুনতে হল। সাথে ফার্সী ভাষায় ডকুমেন্টারী। আশেপাশের সবাই মুহুর্মুহু হাততালি দেয় আমরা কিছুই বুঝি না। অভদ্রতা হবে ভেবে ঘুমাতেও পারি না। । এর মাঝে খেয়াল করলাম আমাদের সাথের মেয়েরা বেশ হাসিমুখে অনুষ্ঠানটা দেখছে, মাঝে মাঝে মাথাও নাড়ছে-বিম্ময় এরা কি সবাই ফার্সী বোঝে নাকি? পরে জিজ্ঞেস করতে বলল ওরা আসলে সবাই MP3 প্লেয়ার নিয়ে গান শুনছিল। মাথায় হিজাব থাকায় এই এক সুবিধা বাইরের কেউ বুঝবেই না কানে ইয়ারফোন আছে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত সিরামিক প্রদর্শনী দেখে আমরা যথেষ্ট মুগ্ধ হয়েছিলাম। চা এর কাপ ছাড়াও এদিয়ে যে কতকিছু করা যায় আমাদের ধারণাই ছিলো না। ওইদিন রাতে হোটেলে ফিরে টিভি ছাড়তেই আবার বিছানা ছেড়ে উঠে বসতে হল- সেখানে সিরামিক এর পটারি বানানো দেখাচ্ছে। আরেক চ্যানেলে আজকের অনুষ্ঠানটা দেখাচ্ছে। আর আরেক চ্যানেলে একটা জাপানী ছবি ফার্সি ডাবিং এ দেখাচ্ছে। পরে শুনেছিলাম শুধু সিরামিকের ওপরেই নাকি ওখানে একটা টিভি চ্যানেল আছে। ধন্য সেমনান, ধন্য সিরামিক। সেমনান ছাড়বার দিন প্রত্যেককে একটা করে সিরামিকের বাটি উপহার দেয়া হল।
গোরগান
একদিন থাকবার পরই সিরামিকের নগরী সেমনান ছেড়ে আমরা রওনা হলাম গোরগানের দিকে। গোরগান হল ইরানের গুলিস্তান (ওদের উচ্চারণ অনেকটা ‘গোলেস্তাঁ’) প্রদেশের মূল শহর। এখানে বলে নেই- ঢাকা ছাড়বার সময় এই নাম নিয়ে আমাদের বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। যেদিন বাক্স পেটরা নিয়ে এয়ার পোর্টে যাচ্ছি এলাকার পরিচিত মুদি দোকানী জানতে চাইল কোথায় যাচ্ছি (বললেই হত ইরান) আমি বলি গুলিস্তান। তারপর দোকানী আবার জানতে চাইল তারপর কোথায় যাব, আমি বলি কেন বাংলাদেশে আবার চলে আসব। বেচারা ব্যাপার কিছুই বোঝে না। তন্ময়ও প্রায় কাছাকাছি সমস্যার মধ্যে দিয়েই গেছে। যাই হোক গোরগানের যে হোটেলে আমাদের রাখা হল সেটাও প্রাসাদোপম, নাম ‘আজিন হোটেল’। প্রায় বার ঘন্টা বাস জার্নিতে সবাই অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম বলে কোনমতে খেয়েদেয়ে নাক ডাকা শুরু করলাম। পরদিন ঘুম ভাঙ্গলো আমাদের অন্যতম গাইড কাম সিকিউরিটি আগা সুলতানীর ডাকে (আগা মানে সম্মানিত বা জনাব)। এই সুলতানীর ডাক অগ্রাহ্য করবার মানসিক জোর আমাদের কারোরই ছিল না। প্রথম কারণ ভদ্রলোকের উচ্চতা সাড়ে ছ’ফুট সেই অনুপাতে বেধ। আর তার ভিজিটিং কার্ড এ লেখা আছে ইনি গত বছরের ওয়ার্ল্ড কিক বক্সিং এর চ্যাম্পিয়ন। আমরা দ্রুত উঠে পড়ি। খেয়েদেয়ে প্রস্তুত হয়ে যাই। জানতে পারি আমাদেরকে গোরগানের শহীদ স্মৃতিসৌধে নিয়ে যাওয়া হবে। তাদের শ্রদ্ধায় ফুল নিবেদন হবে ও তারপরে আমাদের প্রোগ্রামের সাথে আনুষ্ঠানিক ওরিয়েন্টেশন। গোরগানের স্মৃতিসৌধে গিয়ে আমরা যথেষ্ট বিস্মিত হলাম। সেটা এত বিরাট হবে আমাদের ধারণা ছিলনা। এখানে ইরানের বিপ্লবকালীন সময়ের ও ইরান-ইরাক যুদ্ধের শহীদদের কবর আছে। কবরগুলি পুরো মাটির সাথে সমান করা। কোনটাই বাঁধানো না। শুধু কিছু পাথর খন্ডে শহীদদের নাম লেখা। লোকজন কিন্তু কবরের ওপর দিয়েই সমানে হাঁটাহাঁটি করছে। স্থানীয় লোকজনের দেখে আমরা বুঝতে পারলাম ওরা শহীদদের যথেষ্ট সম্মান করে। স্মৃতিসৌধ থেকে কিছুটা দ্রবীভূত মন নিয়ে সবাই এবার আমাদের মূল অনুষ্ঠানে কেন্দ্রের দিকে রওনা দিলাম। বাস থেকে নামতেই ট্রাম্পেট টাইপের মিউজিক এর সাথে বাঁশী ও ব্যাঞ্জো বেজে উঠলো। উপলক্ষ্য যে আমরাই সেটা বুঝতেই অনেক সময় লাগলো। নিজেদের যথেষ্ট সম্মানিত বোধ করে অডিটোরিয়ামে বসলাম এবং বসবার পর পরই আবার ফার্সি স্পিচ শুরু হল। মেয়েগুলো আবার হাসিমুখে স্পিচ শুনছে। এবার আমরা আর ভদ্রতার তোয়াক্কা না করে ঘুম দিলাম। ফার্সী স্পিচটা অবশ্য ঘুমের জন্য বেশ কার্যকরী, ভাষাটা কিছুটা সুরেলা।
প্রথম দিনের পরিচয়পর্ব শেষ হতে সবাই হোটেলে ফিরলাম। রুমে আবারো সেই ফার্সী চ্যানেল আর জাপানী মুভির ফার্সি ডাবিং। এর পরদিন থেকে আমাদের মূল ওয়ার্কশপ শুরু হল।
ঊনিশ বছরের আলী রেজা
আমাদের মূল প্রোগ্রাম শুরু হল। প্রথমেই একটা টেম্পোরারি শেড আকৃতির অডিটোরিয়ামের শিল্পীদের বিভাগ অনুযায়ী আলাদা করে ফেলা হল। কার্টুনিস্টদের শেডে গিয়ে আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এত কার্টুনিস্ট? পুরো ইরান থেকে অনুর্ধ্ব পঁচিশের সব কার্টুনিস্ট এখানে চলে এসেছে। তাদের সাথে কথাবার্তা বলে দুটো জিনিস বুঝলাম এক. তারা ইংরেজী বলতে গেলে পারেই না। দুই. এরা সারা বছর ধরে এই আন-র্জাতিক ফেস্টিভ্যালটার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। যাই হোক যত প্রস্তুতিই নিক দেশ থেকে আসবার সময়ই আমি মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম যে আন্ডার টুয়েন্টি ফাইভ এ আমার চেয়ে ভালো আর কত ভালো আঁকবে? আমার কাগজে কলমে অভিজ্ঞতাই যেখানে ১২ বছর? (এই কারণেই বোধ করি প্রথম দিন ওয়ার্কশপ থেকে ফিরে আমার রাতে ঠিকমত ঘুম হয়নি।) আমাদেরকে বিচারকরা গোটা ছয়েক বিষয় বলে দিলেন- বন্ধুত্ব, পরিবেশ, শানি-, একতা, আবর্জনা ... ইত্যাদি, এগুলোর যে কোন বিষয় নিয়ে কার্টুন করতে হবে। অথবা কারো ক্যারিকেচার করতে হবে। শুধু বিষয়বস্তু ও নাম কাজটার পেছন দিকে লিখে দিতে হবে। আমরা কাজ শুরু করলাম। এই কাজ শুরু করাটা তন্ময় পরের কয়েকদিন খুব সুন্দর অভিনয় করে আমাদের দলের সবাইকে দেখিয়েছিল। সেটা হল দু’জনে খাতা কলম পেন্সিল নিয়ে পৃথিবীর সেরা কার্টুনিস্টদের মত দ্রুতবেগে ড্রয়িং শুরু করলাম ও ড্রয়িং করতে করতে হঠাৎ আশেপাশের দু’ একজনের খাতার দিকে তাকালাম সেই সাথে হাতের গতি কমতে লাগল। একপর্যায়ে হাত থেমে গেল আর সেটা উঠে এল মাথায়। ব্যাপারটা আসলেও অনেকটা তা-ই হয়েছিল। ইরানী কার্টুনিস্টরা যে এতটা ভাল আঁকার হাত নিয়ে এসেছে আমাদের সেটা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। এসব ড্রইং ইন্টারনেটে দেখলে আমি নিশ্চিত ধরে নিতাম কোন মাস্টারক্লাসের কাজ, কিন্তু এখন যে, এগুলো আমার চোখের সামনে হচ্ছে! আমরা আক্ষরিক অর্থেই আমাদের কাজ থামিয়ে দিলাম, পাকিস্তানি সানা তার কাজ না থামিয়ে আমাদের বলতে লাগলো ‘ডোন্ট লুক এট আদার্স, জাস্ট কিপ ড্রইং, আদার ওয়াইজ উই অল উইল গেট আপসেট’ । আর আপসেট- আমরা ততক্ষনে রীতিমত ডাউনসেট পরিস্থিতিতে চলে গেছি। আমার মনে হয় ড্রইংয়ের কোয়ালিটি লিখে বোঝানোর চাইতে গোটা দুইয়েক উন্মাদের এই পাতায় ছাপিয়ে দেই, অঙ্কনবোদ্ধারা দেখে মন্তব্য করুন। ওদের সবচেয়ে অসাধারণ ক্যারিক্যাচারিস্ট যে ছেলেটা তার বয়স ঊনিশ! নাম আলী রেজা। তার পোর্টফোলিও দেখে আমি মনে মনে বললাম- ‘আমার এখানে আসাটাই ভুল হইছে’ পৃথিবীর প্রথম সারির যে কোন ক্যারিকেচারিস্ট এর পাশে একে দাঁড় করানো যাবে। আর পিচ্চির চেহারা দেখে মনে হয় বয়স বড়জোর চৌদ্দ। (পাঠকদের জন্যে পৃথিবীর অন্যতম সেরা ক্যারিকেচারিস্ট এর করা ক্যারিকেচার ও তার ছবি দেয়া গেল)। আরেক সাড়ে ছ’ফুট দানো আকৃতির (এই ফিগার আর হাইট থাকতে একটা মানুষ কেন একটা ৮ ইঞ্চি ৪ই পেন্সিল দিয়া কার্টুন আঁকে আমি বুঝি না) ক্যারিক্যাচারিস্টকে দেখা গেল একজন বিচারকের ক্যারিকেচার করছে। এমন গ্র্যামাটিকাল ফর্মের ভাঙচুর যে সামনা সামনি বসে হেসে খেলে করে দেয়া যায় সেটা নিজের চোখে না দেখেলে বিশ্বাস করতাম না। মজার ব্যাপার হল এইসব অসামান্য কার্টুনিস্টদের প্রায় কারেরাই কোন ওয়েব সাইট নেই (নিজের ওয়েব সাইট করবার পরিকল্পনাটা আবার মাটি চাপা দিলাম।) এমনকী ওই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের কোন ই-মেইল আইডিও নেই। যাই হোক প্রথম দিন তন্ময় আর আমি বুঝে গেলাম এখানে কার্টুন আঁকলেও লোকে হাসবে ঠিকই তবে অন্য কারণে। তন্ময় অন্যদের ড্রয়িং দেখে বলতে শুরু করল - “বুঝছেন বস্ আমরা কিন' আমাদের এওয়ার্ড পায়া গেসি। এই যে সিলেক্টেড হয়া ইরানে আসছি এইটাইতো একটা এওয়ার্ড না? হা হা হা ।” আমিও শুকনো উত্তর দেই “হা হা হা” । আমরা কার্টুন আঁকবার বদলে প্রত্যেকের টেবিলে ঘুরে ঘুরে পরিচিত হতে থাকলাম আর তাদের পোর্টফোলিওর ছবি তুলতে লাগলাম। আমাদের তিন জুরি অবাক চোখে আমাদের দেখতে লাগল। এই তিন বিচারকদের কথা এবারে বলে নেই। তিনজনই অতি সৌম্য ভদ্র চেহারার লোক। কিন' একটু ভাল করে চোখের দিকে তাকালেই তাদের প্রবল বুদ্ধিমান তীক্ষ্ম এবং কিঞ্চিৎ দুষ্ট দৃষ্টিটা দেখা যায়। তারা তিন জন হলেন- জাভেদ আলী জাদেহ, বাহ্মান আব্দী, ও আরদেশির রোস্তামী। পরে Irancartoon এর ওয়েব সাইট ও দু’টো বই থেকে জানতে পারি ওনারা ইরানী কার্টুনের প্রায় কিংবদন্তি তুল্য মানুষ। ইরানের কার্টুনের এতো ব্যাপক প্রসারের পেছনে এনাদের বিরাট এক ভূমিকা আছে। ইরানের এই কার্টুন বিপ্লবের আধুনিক ইতিহাস নাকি মাত্র চৌদ্দ বছরের। আধুনিক ইতিহাস বললাম কারণ, ইরানের কার্টুন আঁকা-আঁকি শুরু হয়েছিল সেই ১৯০৬ সালে! তখন ইরানে রাশিয়ান জার এর শাসন চলছিলো। ১৯০৬ এর ৭ই এপ্রিল প্রথম ‘মোল্লা নাসরেদ্দীন’ নামক কার্টুন পত্রিকা বের হয়। ইরানের সেই ইতিহাসটা নিয়ে আশা করি আরেক দিন লেখা যাবে। আমরা আমাদের ওয়ার্কসপে ফিরে আসি।
লাঞ্চ ব্রেকের সময় আমাদের দলের অন্যান্যদের সাথে দেখা হল। হাসানকে তাদের কি অবস'া জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করবার আগেই সে আমাদের থামিয়ে দিয়ে শুরু করল ‘ইন আফ্রিখা’ (তার প্রতিটা কথাই ‘ইন আফ্রিখা’ অথবা ‘ইন খেনিয়া’ দিয়ে শুরু)। উই ইউজ্ড টু সিঙ এ সঙ, বব মার্লে’জ সঙ’ বলে সে ‘ডোন্ট লুজ হোপ’ এভরিথিং উইল গনা বি অ’ রাইট গাওয়া শুরু করল। হঠাৎ গান থামিয়ে চোখ বড় বড় আমাদের বলল ‘দিস্ ইজ দা পয়েন্ট - ডোন্ট লুজ হোপ’। বুঝলাম বেচারার অবস্থা আমাদের চেয়েও খারাপ। মাসুম ভাইকে দেখলাম মাথায় দু’হাত দিয়ে দাঁত খিঁচে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের দেখে বললেন, ‘এরা যে এত এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করে আমার ধারণাই ছিল না। আমাদের চারুকলায় মাস্টার্স এর আগে এত এক্সপেরিমেন্ট করতেই দেয় না, আমি তো রিয়েলিস্টিক করতে গিয়া পুরা ধরা।’’ একে একে দলের অন্যান্য সদস্যদেরও দেখলাম মুখ চোখ শুকনা। পাকিস্তানি আহমেদ খেপে ভোম। কারন গ্রাফিক ডিজাইনিং এ কোন রকম ইন্টারনেট থেকে নামানো ইমেজ ব্যবহার করা যাবেন, পেন ড্রাইভ ব্যবহার নিষেধ ক্যামেরা ব্যবহার নিষেধ- ‘তো ম্যায় কেয়া হাওয়া সে ডিজাইন প্রডিউস করু ইয়ার?’ মোট কথা প্রথমদিন আমাদের সবারই মন টন খারাপ হয়ে গেল। শুধু কুয়েতি শরীফা দাশতি নামের মেয়েটা কে দেখা গেল হাসি মুখে হাঁটাহাটি করছে। এটার কারণও অবশ্য আমরা জানি। এই মেয়ে খুব সম্ভব কোন শেখ টেখের মেয়ে হবে। রাজেন্দ্রানীর মত চলাফেরা, গোটা আড়াই দিন ধরে সে একটা পেইন্টিং করল তার সাদা এপ্রনের কোথাও এক ফোঁটা রং না মেখে। যেখানে আজারবাইজানি জালালের জিন্স, সাদা শার্ট আর চুলেও রঙ মাখামাখি। মেয়েটার এত আনন্দে থাকবার কারণ আমাদের এই শেডের নিচে সবচেয়ে কাঁচা কাজ আসলে তার, ওসব নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথাও নেই, সত্যি বলতে আমাদেরও নেই। তন্ময় প্রথমদিন ঠিকই বলেছিল- “ খালি চেহারাটার জন্য মাপ কইরা দিলাম-এই ড্রয়িং নিয়া এ আসছে কিভাবে?” প্রথমদিনের ওয়ার্কশপ শেষে হোটেলে ফিরে আমরা ডিনারের পর লবিতে সিদ্ধান্ত নেই কাল থেকে অন্য কারো কাজের দিকে তাকাবই না। নিজে যা পারি তাই করব। তাই সই। এবং সত্যি সত্যিই পরদিন আমরা বেশ ভালো কাজ করলাম। আমি পাঁচটা কার্টুন করে ফেললাম। তন্ময় ৪টা, মাসুম ভাই একটা এবস্ট্রাক্ট নামিয়ে দিয়েছেন, মারজিয়া তন্ময়ের গামছা দেখে দেখে তাঁর রিক্সাওয়ালার গামছাটা আঁকছেন। কাজ জমা টমা দিয়ে সবাই বেশ হালকা মেজাজে বের হলাম। আগা সুলতানী জানালেন আজ একটা পাহাড়ে যাওয়া হবে। সবাই চেঁচিয়ে উঠলাম হ্যাঁ হ্যাঁ পাহাড়ে যাব। (সবাই আমরা যতবার চেচাঁচ্ছিলাম ততবারই বেশ মজার কিছু সাউন্ড হচ্ছিল বিভিন্ন ভাষা মিলে সে এক ব্যাপার। আমি আর তন্ময় বাংলায় ‘যাব! যাব!’ পাকিস্তানি, ‘যাউঙ্গি, যাউঙ্গি!’ চাইনীজ মেয়ে দুটো ‘চ্যাং ছোং ছেন’ আলবেনীয়ানরা ... ... ... (মনে নেই কি) বলে চেঁচাত। যে পাহাড়টায় নেয়া হল সেটায় মাইক্রোবাসে করেই প্রায় চুড়োয় উঠে যাওয়া যায়। জায়গাটার নাম ‘নাহোরখোরান’। খুব সুন্দর দৃশ্য। রাতের ঝলমলে গোরগান শহরটা পুরো ছবির মত ওখান থেকে দেখা যায়। ঘন্টা খানেক নাহোরখোরান এ থেকে আমরা আবার হোটেলে রওনা দিলাম।
ফোন কল ও লন্ড্রি বিল
একটা ব্যাপার এতক্ষণ বলাই হয়নি। ইরানের টাকার মান। আমরা তেহরান এয়ারপোর্টে নামবার পরেই আসলে লাখোপতি হয়ে যাই! আমাদের বাংলাদেশী এক টাকায় ইরানের প্রায় ১৩৩ টাকা! অন্যভাবে বলা যায় এক ডলারে ইরানের প্রায় এক হাজার টাকা। প্রথমদিন আমাদের একটা ফোন কলের পরে রুমে বিল আসে পঁচিশ হাজার রিয়াল। আমাদের তো প্রথমে কলিজা চিপ্ দিলো। পরে আধাঘন্টা মোবাইল সেটের কেলকুলেটার টেপাটেপি করে দেখি সেটা আমাদের তিরিশ টাকার মত। আর কোন কিছু কিনতে গেলে ওখানে কমাতে হয় নিদেন দুই থেকে তিন হাজার রিয়াল। নয়কো সেটা আসলে গোনার মধ্যেই পড়বে না। প্রথম দিন পাকিস-ানী ফাতিমার দুটো কাপড়ের লন্ড্রী বিল আসে পঁয়ত্রিশ হাজার রিয়াল। বেচারী পুরোটা দিন পরে বিড় বিড় করে -‘দো কাপড়াকে লিয়ে থার্টি ফাইভ থাউজ্যান্ড? হাউ অন আর্থ ?’
ঝরনা ও পুরস্কার
পরদিন আমরা গেলাম গোরগানের প্রসিদ্ধ পর্যটন কেন্দ্র ‘আলী আবাদি অপ্সুরা’ (আমি নামটা পুরো নিশ্চিত নই, একে মেমোরি খারাপ তায় ফার্সী উচ্চারণ বোঝা বেশ কষ্ট) নামক ঝরনা দেখতে। জায়গাটা সত্যি সুন্দর। চারদিকে ঘণ জঙ্গল, থেকে থেকে পাহাড়ী পথে বিছানো পাথরের সিঁড়ি, হঠাৎ নেমে গেছে গিরিখাত। ওই নীচে বেগে পাহাড়ী নালা বয়ে যাচ্ছে। এখানেও সেই তাঁবু প্রেমী ইরানী অনেকগুলো পরিবার দেখতে পেলাম। নালার দু’পাশে দিব্যি পিকনিক জমিয়ে ফেলেছে। আমরা ওই সুন্দর ও যুগপৎ দুর্গম পথটা পার হয়ে অবশেষে মিনিট চল্লিশের মাথায় ঝর্ণাটা দেখতে পেলাম। দেখেই বুঝলাম প্রতিদিন ব্রেকফাস্টের সময় লবিতে এই ঝর্ণার পোস্টারটি-ই দেখি। ঝর্ণার পানি বরফ-ঠান্ডা, বেশিক্ষণ দাঁড়ানো অসম্ভব। এর মধ্যে আগ্রহের আতিশয্যে আজারবাইজানী জালাল আর পাকিস্তানি ফাতিমা পানিতে ঝাঁপিয়ে (পানিতে নামা নিষেধ ছিল তারা যুক্তি করে ‘হঠাৎ পড়ে গেছি’ এমন একটা ভাব ধরে) এখন ঠকঠক কাঁপছে। আফগান কার্টুনিস্ট কাম আর্কিটেক্ট মেহেদী আমিনী প্রমাণ সাইজের এক পাথর খন্ডে বসে তার চেয়েও বিরাট এক পাথরে বসা কাজাখস্তানি রাজকন্যাসম আনারার দিকে তাকিয়ে আছে। আহমেদ ইতিমধ্যে দু’বার ক্যামেরা সমেত আছাড় খেয়ে উঠে বারবার ক্যামেরা চেক করছে। ওদিকে তার হাঁটু থেকে রক্ত ঝরছে কোন খেয়াল নেই। সোজা কথা ওখানে গিয়ে সবাই যে যার মত হয়ে গিয়েছিলাম, একটু গম্ভীর লোকটা আরো গম্ভীর ছেলেমানুষ ধরনের যারা তারা আরো একটু বেশী ছেলেমানুষ।
ঝরনার সাথে প্রায় তিন ঘন্টার সুন্দর সময় কাটিয়ে আমরা আবার হোটেলে ফিরে এলাম। আজ সন্ধ্যায় প্রোগ্রামের শেষ, আর সেই সাথে প্রাইজ গিভিং। ফর্মালিটি রক্ষার জন্য যাচ্ছি। যাবার সময় আমি আর তন্ময় দেশ থেকে নিয়ে আসা পাঞ্জাবী বের করলাম। কিন্তু সেগুলো এতোটা কুঁচকানো যে পড়া ঠিক হবে কিনা ভাবছি। এমনি সময় রুমের ফোন বেজে উঠল। আহমেদ ফোন করেছে সে বলছে - ‘লিসেন ইয়ার- আই হ্যাভ টু ওয়্যার মাই কুর্তা টুডে বাট দেয়ার ইজ নো আয়রন ইন দিজ হোটেল, কুড ইউ থিংক আই এম লুকিং লাইক এ ক্লাউন।’ জবাবে আহমেদক জানালাম যে সে একা না আমরা আসলে তিনজন ক্লাউন আজ প্রোগ্রামে যাচ্ছি। এই একবারই আমরা বুদ্ধিমানের মত নির্ধারিত সময়ের চল্লিশ মিনিট পরে রওয়ানা দিলাম বলে ফার্সি স্পিচটা এবার শুনতে হলনা। যথারীতি সীটে বসে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় মঞ্চ থেকে এনাউন্স করা হল- পেইন্টিং ক্যাটাগরিতে থার্ড হয়েছে কাজাখস্তানের আনারা! আমরা পুরো দল বিচিত্র ভাষায় চেঁচিয়ে উঠলাম। আহমদ উলু দেয়া শুরু করল। আমাদের সামনের সারি থেকে একটু পরপর এক পক্ককেশ বৃদ্ধ অবাক হয়ে ঘুরে তাকাচ্ছে। আমরা তাকে থোড়াই পরোয়া করছি (অনুষ্ঠান শেষে জানতে পারি ওই লোক এই ইভেন্টের প্রধান বিচারক)। -আবার উলুদ্ধনি, চ্যাং ছোন ছেন, ও আলবেনিয়ানদের ... কি জানি কি ধ্বনি, কারণ এবার নাম ঘোষণা হয়েছে সেনেগালের ছেলে ইয়েলির। এরপর একে একে আমাদের বিস্মিত করে চাইনিজ, তাজিকিস্তানি ও আজারবাইজানিদের নাম ঘোষণা হতে লাগলো। দুরু দুরু বুকে আমরা ভাবতে লাগলাম কোনভাবে যদি আমাদের নামটাও চলে আসত। আহমদ! গ্রাফিক্স বিভাগে বিজয়ী হিসেবে আহমেদের নাম বলা হল। আহমেদ তিন হাত লাফিয়ে উঠলো। আমরা আবার বিভিন্ন ভাষায় চেঁচাতে লাগলাম। সেই বৃদ্ধ আবারো ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আহমেদ ফিরে আসতে না আসতেই একে একে আমাদের বাংলাদেশের চারুকলার মারজিয়া ও মাসুমের নাম বলা হল। যাক, অন্তত বাংলাদেশের মুখ রক্ষা হয়েছে। এরপর যখন কার্টুন ক্যাটাগরিতে তন্ময়ের নাম ঘোষণা হল সাথে সাথে আমার হার্টবিট চতুর্গুনে চলে গেল। এবং সত্যি সত্যি এরপর মঞ্চ থেকে আমার নাম বলা হল। ইরানের মাটিতে পরপর চারবার বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করা হল। আর কোন দেশের সবাই একসাথে এই কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। এওয়ার্ড পাবার পর ওদের জাজমেন্ট কোয়ালিটি খারাপ ছিল, না আমাদের কাজ ভালো ছিলো এই বিতর্কে কেউ গেলাম না। এই একটা ইভেন্টে বুঝতে পারলাম কার্টুনে ড্রয়িং স্কিলটা আসলেও সেকেন্ডারী। মূল দেখা হয় আইডিয়াটা, ড্রয়িং এর বিচারে ইরানীগুলির ধারে কাছে আমরা ছিলাম না। অতি সাধারণভাবেই ক্যারিকেচার ক্যাটাগরিতে ফার্স্ট হয়েছে ঊনিশ বছরের আলী রেজা। ওই দিন জানতে পারলাম, ছেলেটা বোবা।
তেহরানে তিন দিন ও বিদায়
ফিরতি জার্নিতে পরদিন সবাই আবার তেহরানে ফিরে আসি । এসেই শুনি এবার একে একে সবার যাবার পালা। যার যেদিন ফ্লাইট আছে সে সেদিন চলে যাবে। সবার প্রথমে গেল হাসান। আমরা তাকে বিদায় দিতে ঘুম থেকেই উঠতে পারিনি। এরপর গেল আজারবাইজানিরা। তখনই আমরা টের পেলাম আমাদের খারাপ লাগছে। মাত্র নয়টা দিন আমাদের মনে হতে লাগলো নয় যুগ ধরে আমরা একসাথে ছিলাম। সেনেগালের ইয়েলি পরদিন যাবার সময় কেঁদে ফেললো। আমাদেরও চোখ ভিজে উঠলো। মাত্র এ ক’টাদিনে যে মানুষের প্রতি এত মায়া জন্মে যাবে ঢাকায় থাকতে কল্পনাই করিনি। পরদিন আমাদের পালা, একদিন বোনাস পাওয়াতে আমরা মাঝে তেহরানের এনসিয়েন্ট মিউজিয়ামটা ঘুরে আসি (শুধু তেহরানে মোট মিউজিয়ামের সংখ্যা মোট ৪৪ টা!)। যেসব ছবি এতদিন বইয়ে ছাপা দেখি এসেছিলাম, পার্সেপোলিসের সে সব থাম, সিঁড়ি ও মুর্তিগুলো এবার নিজ চোখে দেখলাম। রাতের বেলা শুধু আলবেনিয়ান এলটন এভিস আর সাদিক সাহেবকে হোটেল ফেরদৌসীতে রেখে এলাম। যথারীতি আমাদের সাথে আছেন মিসেস ফা’মুরী - মানে মিঃ নমিনী। এয়ারপোর্টে এসে এইবার ওনার বিরক্তির কারণটা জানলাম। এই ভদ্রলোক বিশ্ব বিখ্যাত একজন ভাস্কর। তাঁর মূল কাজ হল অস্কারের গোল্ড মুর্তিগুলো হাতে বানানো; পুরো বছর উনি ভেনিস শহরে থাকেন। আর কাউকে পাওয়া না যাওয়ায় বোধ করি ওনাকে দিয়ে আমাদের আনা নেয়া করানো হচ্ছে। তাঁর পরিচয পেয়ে তাঁর সাথে ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে ফেলা হল।
প্লেন ছাড়লো ভোর সাড়ে ছ’টায়। নীচে ধোঁয়াশা মাখানো তেহরান তার চমৎকার শিল্পমনা মানুষ আর আমাদের কিছু স্মৃতি নিয়ে পড়ে রইল। (আর পড়ে রইল আমার একটা গামছা, ভুলে হোটেলে ফেলে এসেছি।) মনে মনে বললাম, আবার দেখা হবে। আবার একদিন আমি অবশ্যই আসবো এখানে।
অবশিষ্টঃ
ঢাকায় ফিরবার পরে সবাই বারবার জানতে চেয়েছে - গ্যাঞ্জাম দেখো নাই? ওইখানেতো বিরাট মারামারি চলতেছে। আমরা বলি - না তো কিছুই তো দেখি নাই। বাস্তবিক ইরানের প্রশাসন এতটাই দক্ষ যে প্রাণ শহর তেহরানে থাকবার পরও আমরা টুরিস্টরা কিছুই টের পাইনি। ওদের রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোও অনেক সমন্বিত হয়। মূল মিছিলগুলো হয় আজাদী স্কয়ার নামক এক বিখ্যাত চত্বরে। একটা মিছিলের জন্য তাই পুরো শহর অচল হয়ে যায় না। পশ্চিমা মিডিয়া যে কিভাবে সারা বিশ্বকে বোকা বানাচ্ছে সেটা আমরা এই প্রথম বুঝলাম। ওখানে শহরের অভিজাত শ্রেণীর যেসব তরুণরা বিপ্লব পরবর্তী সময়ে জন্মেছে ও যাদের আত্মীয় স্বজন প্রকৃতপক্ষে শাহ এর পতনের পরে কানাডায় পলিটিক্যাল এসাইলাম এ আছে তারাই এবারের নতুন ভোটার ও মূল আন্দোলনকারী। চবুশ নামের সমবয়সী এক প্রেস ফটোগ্রাফারকে প্রশ্ন করেছিলাম “Whats the problem with this govt. regime?” সে উত্তর দিল, “Corruption, you know? They devore the petro dollars. And another thing, they filter the facebook!”
হা কপাল, ফেসবুক ফিল্টার করে বলে একটা সরকার পতন আন্দোলন করা যায়? আর দুর্নীতির কথা বলছে? মনে মনে বললাম -- আমাদের দেশে আসো চবুশ জীবনকে নতুন করে চিনবে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
হ্যাংওভার কাটিয়ে
একটা সময় ছিল সব জায়গায় লেখা থাকতো (অবশ্যই এখনো আছে) 'রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ'। এখন অবস্থা উলটো। এখন যেন রাজনীতি ছাড়া অন্য আলাপ জমেই না। ...
-
আইডিয়া পাওয়া বা ক্রিয়েটিভ কাজ ইত্যাদিকে এখনো আমাদের সমাজে একটা অলৌকিক প্রতিভা হিসেবে ভাবা হয়। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সত্যও বটে। ত...
-
দীর্ঘ দশ মাস পর ২০১৮ সালের বিজ্ঞান বিভাগের নবম-দশম শ্রেণির ৫ টা (গণিত, উচ্চতর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান) ও আর্টস ও কমার্স বি...
-
এইবার আমরা হুইলের আসল কাজটা দেখি। মানে রঙ করার সময় এটা আসলে কি কাজে লাগে। একটা ছবি রঙ করার সময় আসলে মূল যে ব্যপারটা মাথায় আগে আনতে হবে সেটা ...
ছবিগুলো কী এখানে দেয়া যায় ?
ReplyDeleteঅবিশ্যি দেয়া যায়, আসলে ছবি ছাড়া এই ল্যাখা হাফ ডান, তবে এত ছবি আপলোড করতে হলে আমার অফিস থেকে করতে হবে, বাসায় সিটিসেল 'ঘুম' এর ঝিমানি স্পিড (২.৩ kbps) এ হবে না, অচিরেই উঠাচ্ছি।
ReplyDeleteথ্যংস ফর রিডিং।
ছবি দিলেন না যে এখনো?!
ReplyDeleteসুন্দর লাগলো পড়ে। ভাই ইরানে পড়াশোনার ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন?
ReplyDelete