যেই মানুষটার একটা বড় ভূমিকা আছে আমার কার্টুন আঁকায়- সেই প্রাণ কুমার শর্মা মারা গেছেন। বিডিনিউজের বাচ্চাদের সেকশন কিডজ এর জন্যে লেখা। পুরোটা পেতে এখানে ক্লিক করুন।
তোমরা তাকে
সেভাবে চিনবে কি না আমি কিন্তু ঠিক বলতে পারছি না। তোমরা বরং দোরেমন বা বেনটেন
অথবা অগি এন্ড দ্যা কক্রোচেস কে ভালো চিনবে। তবে বলে রাখি আমরা যারা কার্টুন
নেটওয়ার্ক, মোবাইল ফোন এমনকী ইন্টারনেট ছাড়া বড় হয়েছি তারা সবাই গত ৫ ই অগাস্টে অনেক
মন খারাপ করে বসে ছিলাম। কারণ আমাদের সময় মোবাইল ফোন ইন্টারনেট প্লে স্টেশন
ইত্যাদির অভাব যিনি ভুলিয়ে দিয়েহিলেন সেই কার্টুনিস্ট প্রাণ সেদিন মারা গেছেন। ভারতীয়
কার্টুনিস্ট এই প্রাণ রায় আসলে কী এমন যাদু জানতেন যাতে করে আমরা সবাই এত মন খারাপ
করে আছি এখনো? আশা করি তোমরা সবাই না জানলেও অনেকেই উত্তরটা মনে মনে জানো। প্রাণ
রায় হচ্ছেন উপমহাদেশের বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র চাচা চৌধুরীর স্রষ্টা। কেউ যদি এই
কমিক্সটি না
পড়ে থাকো তাহলে আমি বলব তোমরা একটা বিরাট মিস করেছো। লাল পাগড়ী পরা
ছোটখাটো এক চরিত্র আর তার সাথে ভিনগ্রহের এলিয়েন পালোয়ান- সাবু। সাথের ছোট্ট কুকুর রকেট মিলে যদিও হুট করে
তোমাদেরকে এস্টেরিক্স ওবেলিক্স ও ডগমাটিক্স কে মনে করিয়ে দিতে পারে তবে একটু পড়বার
পরেই বুঝে যাবে এটা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। এমন সহজ সরল ফান করে যে একটা দূর্দান্ত
গল্প টানা বলে যাওয়া যায় তার একটা দারুণ উদাহরণ এই চাচা চৌধুরী সিরিজ। কী নেই
তাতে? টানটান উত্তেজনার ব্যাংক ডাকাতি আবার সাথে সাথেই বুদ্ধিমান চাচার পাগড়ীর
ফাঁদে পড়ে তাদের আটক হওয়া। সাথে গাটুগুটূ টিঙ্গু মাস্টার। হঠাত হঠাত এসে পড়া ডাকু
গব্বর সিং, চাচার গিন্নী মানে চাচী। তাঁর হাতে বানানো একশো লুচি দিয়ে নাস্তা সেরে
সাবুর উঠে বসে ক্রিকেট ব্যাট হাতে ডন ব্র্যাডম্যানের সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলে
আবার তার পরেই ভয়ানক ডাকুদের তাড়া করে ফেরা। সোজা কথা দম ফেলার ফুরসৎ পাওয়াই ভার। একটা গল্প পড়ে শেষ না করতেই
আরেকটা, সেটা শেষ করে আরেকটা। কোথাও কোন জটিল প্যাঁচঘোঁচ নেই, নেই মাথা খাটিয়ে
গল্প বোঝার দায়। একেবারে জলবৎ তরলং গল্প। এখানেই প্রাণ
নামের এই লোকটার কমিক্স এর 'প্রাণ' লুকানো। তবে প্রাণের এই কমিক্স আঁকার গল্পটা
কিন্তু আরো মজার। ভদ্রলোক তো পলিটিক্যাল সায়েন্স থেকে মাস্টার্স করলেন দিল্লী
থেকে। তারপরেই তাঁর মাথায় ঢুকলো লাড্ডুর প্যাঁচ। মানে আঁকাআঁকির প্রবল ঝোঁক থেকে
সটান ঢুকে গেলেন মুম্বাইয়ের স্যার জে জে স্কুল অব আর্ট এ। দিল্লী থেকেই প্রাইভেট
স্টুডেন্ট হয়ে সেই পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু মনের মধ্যে যার এত এত
মজার আইডিয়া আর গপ্পের বুড়বুড়ি আর্ট কালচারের ঘোরালো প্যাঁচালো ইতিহাস পাতিহাস
তাঁর ভালো লাগার কথা না। তাই সেই কোর্স শেষ না করেই শুরু করে দিলেন নিজের যেটা
ভালো লাগে সেই 'কার্টুন'। প্রাণের নিজের ভাষায়-'আমি আসলে এত সাত পাঁচ ভাবিনি। আমি
বুঝেছিলাম আমাদের কোন সুপারম্যান দরকার নেই, কাউকে সুপার হিরো হয়ে আকাশ দিয়ে উড়ে
উড়ে গুণ্ডা তাড়ানোর দরকার নেই। আমাদের দরকার একেবারেই আমাদের নিজস্ব ভারতীয়
সাধারণ
মানুষ- হ্যাঁ তাঁর বুদ্ধি হতে হবে অসাধারণ' তা সেই চাচা চৌধুরীর বুদ্ধি অসাধারণই
বটে। সিরিজটার অন্যতম বিখ্যাত ডায়ালগ তাই ছিল 'চাচা চৌধুরীর বুদ্ধি কম্পিউটারের
চেয়েও প্রখর'। এটা ছিলো আমাদের সবার মুখস্ত ডায়ালগ। আর ওদিকে ভালো মানুষ সাবু? যে
আবার রেগে গেলে রক্ষা নেই। তখন বলা হয় 'সাবু রেগে গেলে কোথায় আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ
হয়'। তা ভয় পাবার কারণ নেই সাবু সহসা রাগে না। তবে হ্যাঁ লড়াইটা যদি হয় অমর ভিলেইন
'রাকা'র সাথে তবে এমন দু একটা অগ্ন্যুতপাত হতেই পারে। বিষ মনে করে ভুলে এক
কবিরাজের অমৃত আরক খেয়ে অমর হয়ে যায় রাকা নামের এক ডাকাত। তার পর থেকে তাকে থামায়
কার সাধ্য? ডাক পরে সেই চাচা আর তার এলিয়েন পালোয়ান সাবুর। সে এক দূর্ধর্ষ লড়াই।
প্রতিবারেই কোন না কোনভাবে রাকা তার বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবী তছনছ করা শুরু
করে। বুক ধরফর করা টেনশন নিয়ে সেটা এক নাগাড়ে গিলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আর
শুধু চাচা চৌধুরী-ই কেন? প্রাণ নামের এই 'ভারতের ওয়াল্ট ডিজনী' তৈরী করেছেন
বিল্লু, পিংকী, চান্নি চাচী, রমন ও শ্রীমতিজী নামের আরো কয়েকটা কমিক্স চরিত্র।
এতগুলি কমিক্স চরিত্র তৈরী করে আবার সেগুলো প্রায় সবগুলি-ই সমানভাবে জনপ্রিয় করাটা
মুখের কথা না। প্রাণ নামের এই কিংবদন্তী কার্টুনিস্ট যখন এইসব মজার মজার কমিক্স
চরিত্র তৈরী করেছিলেন ঠিক তখন ভারতে শুধু কিছু বিদেশী ইংরেজী কমিক্স এর বাংলা বা
হিন্দী অনুবাদ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যেতো না। প্রাণ দেখলেন- আরে, দেশটা আমাদের
কিন্তু গল্প সব বিদেশী। যার চরিত্র গল্প কৌতুক কিছুই আমাদের না, আমরা তার সব বুঝিও
না- ঠিক অনেকটা আমাদের এখনকার দোরেমন, বেনটেন, জাপানি মাঙ্গা, এনিমে বা এডভেঞ্চার
টাইম এর মত। সেগুলি মজার সন্দেহ নেই, কিন্তু এরা তো আমাদের দেশী কার্টুন না। নিজের
জন্যে নিজেদের গল্প নিজেদের ভাষা না হলে কি চলে? ব্যস বসে গ্যালেন নিজেই আঁকতে,
এবং তার ফলাফল এই ইতিহাস গড়ে দেয়া কার্টুন চরিত্রগুলি। এমনকী সেই ভারত পেরিয়ে
নব্বই সালের পর থেকে বাংলাদেশেও মানে আমাদের এখানেও তাঁর এই কমিক্সগুলি চলে
এসেছিলো। চাইলে যে নিজেদের কমিক্স কার্টুন নিজেরাই বানানো যায় সেটার স্বপ্নও উনি
উপমহাদেশের সবাইকে দেখিয়ে গেছেন। তাঁর আগে অনেকি ভাবতো এগুলি আসলে বিদেশীরাই করবে।
কিন্তু এখন এমনকী বাংলাদেশেঅ বেশ কিছু কমিক্স বই বের হচ্ছে, পত্রপত্রিকায় কার্টুন
ও কমিক্স স্টৃপ বের হচ্ছে, হচ্ছে কমিক্স এর মেলা কমিকন। এগুলি যারা করছেন তাঁরা
কিন্তু এই প্রাণ নামের মানুষটার বই পড়েই বড় হয়েছেন, এবং তাঁর দেখানো পথেই নিজেদের
মত কার্টুন এঁকে যাচ্ছেন। বাংলাদেশেও তাই তৈরী হচ্ছে বাংলাদেশী কমিক্স। আশা করি
অবিস্মরণীয় প্রাণ এর কমিক্সগুলির পাশাপাশি বাংলাদেশী সেই কমিক্সগুলিও দোরেমন পোকেমন
ফেলে আমাদের আরো দারুণ কিছু সময় উপহার দেবে। আপাতত প্রাণ কুমার
শর্মাকে আমরা সবাই মিলে প্রাণের গভীর থেকে একটা ধন্যবাদ জানাই এসো।
আমি ক্লাস টেনে থাকাকালীনও চাচা চৌধুরী পড়েছিলাম... আমার বড় হওয়া খাগড়াছড়িতে। প্রথম প্রাণের কমিক্স পেয়েছিলাম ক্লাস সিক্সে থাকতে। শান্তিচুক্তির পর চাকমারা যখন ইন্দিয়া থেকে চলে এসেছিল তখন অনেক ছেলেমেয়ে ওখান থেকে কমিক্স নিয়ে এসেছিল। ওদেরই একজনের হাত থেকে প্রথম কমিক্সটা পাই আমি। খাগড়াছড়িতে তখন এভেইলেবল কমিক্স পাওয়া যেতোনা। প্রতি বছর স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আব্বু চিটাগাংএ বেড়াতে নিয়ে আসতেন। তখনই সব সংগ্রহ করতাম। মাঝেমাঝে শহরের কাজিনরা আব্বুকে দিয়েও পাঠাতো। অসাধারন লাগতো এক একটা। জানিনা বর্তমানের বাচ্চারা বেনটেন এ এই মজাটা পায় কিনা। :(
ReplyDelete