August 12, 2014

‘প্রাণের কমিক্স: ভিন্ন পাঠ’

চাচা চৌধুরীর স্রষ্টা মরে গিয়ে আমাকে লেখক বানিয়ে দিচ্ছেন :/ এবারে লালজীপের ডায়েরি নামের ব্লগের জন্যে কিঞ্চিত আঁতলা লেখা
*A comedian died in India
পৃথিবী ছুটছে। কোনদিকে তা ঠাহর করাটা কঠিন। সেটা ঠিক কি বেঠিক তার খোঁজ করা আরো কঠিন। ছুটে চলাই নিয়তি ধরে নিয়ে আমরা কোনমতে তার সাথে আঁকশি চড়িয়ে গেঁথে আছি আর ছুটে চলেছি। ছুটছি-চারদিক ভীড়ে ভীড়াক্কার, সবাই চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটছি। সবারই অনেক কিছু বলার আছে কিন্তু কারো অন্যরটা শোনার সময় নেই। তাতে ভাষা কালচার সংস্কৃতি ‘টংস্কৃটি’ সব মিলিয়ে জগা বাবার খিচুরী হয়ে হয়ে থিতিয়ে যাচ্ছে। গালভরা পুঁজিবাদের ধরাচূড়া আর কখনো এভাবে ‘টংস্কৃতি’ সামনে রেখে আকাশ ফুঁড়ে এর আগে আর এতটা ওঠেনি। তাই পৃথিবী আদৌ কোনদিকে যাচ্ছে তা ভেবে বের করাটা এক বিরাট সমস্যাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাঝেও কিছু লোক থাকেন যাঁরা পৃথিবীর সেন্ট্রিপেটাল ফোর্স কে অস্বীকার করেন। তাঁরা ভীড়ে মেশেন না। তাঁরা জানেন ‘টংস্কৃতি’ বলে কিছু নেই। গ্লোবাল ভিলেজ কথাটাও ফক্কিকারি। আছে শুধু ভিলেজ। সেটা পাঞ্জাবের কাসুর গ্রাম ও হতে পারে বা দিল্লীর কাছের গুরগাঁও ও হতে পারে।
আমাদের প্রাণ কুমার শর্মা সেই পৃথিবীর গাড্ডালিকা থেকে দূরে বসে ঠাণ্ডা মাথায় প্রশ্বাস নিয়ে বসা মানুষটা। প্রাণ কুমার শর্মার জন্ম অবিভক্ত ভারতবর্ষে। পাঞ্জাবের কাসুর গ্রাম-এ, দেশ বিভাগের পর যেটা আসলে পড়েছে গিয়ে পাকিস্তানে। মানুষের তৈরী করা বিভেদের কারণে নিজের জন্মস্থান ফেলে এলেও সেই কল্পিত সীমারেখাটা অনায়াসে আবার তুমুলভাবেই অতিক্রম করেছিলেন প্রাণ। সে গল্পই বলতে বসা। না বল্লেও সচেতন ও অসচেতন পাঠকেরা বুঝে গেছেন যে আমরা চাচা চৌধুরী নামের বিখ্যাত কার্টুন কমিক্স চরিত্রের স্রষ্টা প্রাণ এর কথাই বলছি। এ মাসের ৫ তারিখ যার ইহকালীন যাত্রাবিরতি শেষ হল। যাবার আগে তিনি ৫০০’র অধিক কমিক্স এঁকে রেখে গেছেন আর ভক্ত রেখে গেছেন কয়েক কোটি। কিন্তু সে কারণে তাঁকে নিয়ে কথা বলতে বসা নয়, প্রাণ এর পাঠ আজ অন্য কারণে জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রাণ এমন একটা বৈরী সময়ের শুরুতে এমন একটা পদ্ধতিতে আজ করে গেছেন যেটা আমাদের এই সময়টা তথাকথিত গ্লোবালাইজড সময়ে টিকে থকার রসদ দিতে পারে। পলিটিক্যাল সায়েন্সের এই ছাত্র তাঁর প্রথম যৌবনে ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন ‘আমাদের’ আর ‘ওদের’ শব্দ দুটোর পার্থক্য। গ্লোবাল দুনিয়ায় খোলা বাজারের নাম ভাঙ্গিয়ে ছদ্মবেশে ভিনদেশী কালচার ঠিকই ঢুকে যাচ্ছিলো নিজের দেশের মধ্যে। হালের দোরেমন কার্টুনের প্রভাবে ঠিক যে কারণে আমাদের অভিভাবকশ্রেণী বিরক্ত সেই একই কারণ তাঁকেও চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলো। বাচ্চাদেরকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে কার্টুন, সেটা কোন সমস্যা না। কিন্তু সেটা তখনই সমস্যা হতে পারে যখন সেটা অন্য দেশের কালচার নিয়ে ঢুকে যায়।

প্রাণ কার্টুন পছন্দ করতেন। তিনি খেয়াল করলেন ভারতের বাজারে যে সব কমিক্স পাওয়া যাচ্ছে তা সবই বিদেশী। ছোট ছোট ভারতীয়রা বিদেশী কিছু মানুষদেরকে নিজেদের জীবনের হিরো জেনে বড় হচ্ছে। যদিও এগুলি অনুবাদ হয়ে ভারতীয় ভাষাতেই বের হচ্ছে। কিন্তু সেগুলি কোন ভাবেই ভারতের না। এর সমাধানের জন্যে সবচেয়ে সহজ যে পথগুলি আছে যেমন- সব দোষ অন্যদের কেন কেউ কিছু করছে না বা সরকার কেন কিছু করছে না বা এই দেশের কিছু হবে না অন্য দেশে চলে যাওয়াই ভাল- ইত্যাদি না করে তিনি নিজেই কাগজ কলম নিয়ে আঁকতে বসে গেলেন নিজেদের কার্টুন। তিনি প্রথমেই বুঝেছিলেন স্পাইডারম্যানকে ধুতি পরিয়ে দিলেই সে ভারতীয় হয়ে যাবে না। ভারতীয় কার্টুন চরিত্রকে প্রথমে হতে হবে ভারতের মানুষ। তিনি একেবারেই সহজ সাধারণ মানুষদের তাঁর কমিক্স-এ চরিত্র করে আঁকতে শুরু করলেন। চাচা চৌধুরী তো আসলে তাঁর ছেলেবেলায় দেখা সেই কাসুর গাঁয়ের কোন এক লাল পাগরী পড়া চাচারই ছবি। তার সাথে সাইডকিক আকারে এল পালোয়ান সাবু। আর তাদের সাথে কখনই ব্যাটম্যান বা সুপারম্যানের সাইকো কিলার ধরনের জটিল ভিলেন এলো না। এল একেবারে লোকাল পাঁতি ডাকু বা চোর। তার অন্যান্য সিরিজেও যাদের দেখা পাওয়া যায় তারা আসলে ভারতেরই যে কারো পাশের বাড়িতে থাকা চরিত্র। বিল্লু, পিংকী বা চান্নি চাচীকে একটু খুঁজলেই আশে পাশে পাওয়া যায় ওখানে ওখানে। প্রাণ এইসব চরিত্র আঁকার পর ভারতের অনেক সমালোচক আঁকিয়ে নড়েচড়ে বসেন। যারা এদ্দিন পশ্চিমা অংকনরীতিতে কোন এক ভারতীয় ‘ম্যান’ বানানোতে ব্যস্ত ছিলেন তার দেখলেন এক অদ্ভূত কমিক্স বিপ্লব। সুপারম্যান বা স্পাইডারম্যান ছাড়িয়ে কোন রকম অতিমানবীয় ক্ষমতা ছাড়াই সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ছে চাচা চৌধুরী নামের একটা ছোটখাটো আসল ভারতীয় মানুষ। ক্ষমতা বলতে যার বিরাট লাল পাগড়ীর নিচে থাকা ছোট্ট টাক মাথার ভেতরের বুদ্ধি যা নাকি ‘কম্পিউটারের চেয়েও প্রখর’। প্রাণ যাদুমন্ত্রবলে সেই সময়েই যেটা বুঝেছিলেন সেটা হল পশ্চিমা সুপারহিরোরা যতই চমৎকার আর শক্তিশালী হোক না কেন ভারতের কালচারের সাথে তারা কখনই ‘যায় না’। এই ছোট্ট একটা উপলব্ধি-ই তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দিলো। এবং দেখতে দেখতে ভারতের কমিক্স বাজার থেকে বিদেশী কমিক্সদের সরিয়ে দিয়ে নীরবে বিপ্লব ঘটিয়ে জায়গা করে নিলো ‘ডায়মন্ড কমিক্স’।
আমরা এ ব্যাপারে প্রসঙ্গত সত্যজিত রায়ের কথা ভাবতে পারি। পশ্চিম সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারা ভারতীয়দের তালিকা করলে তার ওপর দিকেই থাকবেন রায়- সেই রায়কেও আমরা দেখি বাইসাইকেল থিফ বা সিটিজেন ক্যেইন আর রশোমন আত্মস্থ করে গল্প হিসেবে শেষে আম আঁটির ভেঁপুর দৃশ্যপট টাকেই বেছে নিতে। ইউরোপ এমেরিকার কালচারের রস নিয়ে সেটা দেশীয় খোলসে পুরে উপস্থাপনার ঢংটাই তাঁকে আলাদা করে তুললো। দু’জনে তুলনীয় নন-মান ও ক্ষেত্র নিয়েও বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে; কিন্তু তাঁদের বোধ এর জায়গাটা একই ধরনের। আর এই টংস্কৃতির বাজারে যখন নিজের নাম খুঁজতেও আমরা গুগল এ সার্চ দিচ্ছি অবিরাম তাঁদের এখান থেকে কিছুটা হলেও নেবার আছে। প্রাণ আমাদের সেই পথ দেখিয়ে গেলেন। আমরা দোরেমন নিয়ে হা হুতাশ শেষ করে এখন ‘পাখি’ (বাংলা সিরিয়াল) আটকাতে চ্যানেল বন্ধের কথা ভাবছি। নিজেদের চ্যানেলের বা বইয়ের বাজে মান জায়েজ করতে অজুহাত দেই উন্নত বিশ্বের সুবিধা নেই বলে কিছু করা যাচ্ছে না। বলি ওদের অনেক ‘ফ্যাসিলিটি’। আর ঠিক এই সব অজুহাতের সামনেই হাসিমুখে ভরা প্রাণের ছবিটা বিদ্রুপ হয়ে দাঁড়ায়। ড্রয়িং স্কিল বা ‘আন্তর্জাতিক’ মান বিচারে কখনই তাঁর কমিক্স প্রথম সারির নয়। তিনি পুরোদস্তুর একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের শিল্পীও নন। কিন্তু তাঁর সেই বি গ্রেডের ড্রয়িং-এ সৃষ্ট ছোটোখাটো চাচা চৌধুরী এক ফুঁয়ে অনেকগুলি সুপার-হিরোকে উড়িয়ে দিলো। তিনি বুঝিয়ে গেলেন দেশের মানুষ আপনার কাছে এ গ্রেড এর টেকনিক আশা করে না। তারা আশা করে কেউ একজন তাঁদের গল্পটা বলবে, তাদের ঘটনাটা ভিজ্যুয়াল-এ আনবে।
প্রাণ এর এই এক জীবন ধরে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ-এ দিয়ে যাওয়া শিক্ষাটা আমাদের বাংলাদেশের জন্যে এই মুহুর্তে জরুরী হয়ে পড়েছে। আত্মপরিচয় হাতড়ে হাতড়ে যখন আমাদের গল্পগুলি বিভিন্ন ‘ফরেন’ মাল আমদানীতে ব্যস্ত এবং সমালোচকরা ব্যস্ত অন্য নতুন কার ঘাড়-এ দোষ চাপান যায় সেটা খুঁজে বের করতে তখন প্রাণ এর কাজের ধরন আমাদের সামনে নতুন পথ খুলে দেয়। বিদেশী বাজারের সামনে জোর পায়ে দাঁড়াতে প্রাণের তাগিদে ‘প্রাণ’ এর পথে হাঁটাটাই এই সময়ের কাজ বলে মেনে নেয়া যেতে পারে। গুরগাঁওয়ের এই বৃদ্ধ আমাদের ইঙ্গিতে সেই প্রাণ আরকের সন্ধানই দিয়ে গেলেন।
*A Comedian Died in New York মূলতঃ এলান মুর এর ওয়াচমেন গ্রাফিক নভেলের কোটেশন

No comments:

Post a Comment

হ্যাংওভার কাটিয়ে

একটা সময় ছিল সব জায়গায় লেখা থাকতো (অবশ্যই এখনো আছে) 'রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ'। এখন অবস্থা উলটো। এখন যেন রাজনীতি ছাড়া অন্য আলাপ জমেই না। ...