July 16, 2014

মীনা, রামমোহন (আর আমি)

একটা দারুণ ব্যাপার কারো সাথে শেয়ার করা হয় নি। সেটা হল মীনার একটা পর্বের সাথে আমার কাকতালে যুক্ত হয়ে যাওয়া। ২০১০ এর অগাস্টে হঠাৎ মোকারম ভাইয়ের (উদ্ভিদ বিষয়ে লিখে যিনি গাছ ফুল লতা পাতার যে খাওয়া ছাড়া আরো ব্যবহার আছে সেটার নিরলস প্রচার করে যাচ্ছেন) ফোন। ইউনিসেফ এর মীনা কার্টুন সিরিজের একটা কর্মশালা হবে। সেটায় আমি থাকতে চাই কি না- থাকতে চাই না মানে?? মীনা বলে কথা। আর সেই প্রজেক্টে আসবে ভারতের বিখ্যাত এনিমেটর গুরু রামমোহন আর লেখিকা দীপা ভালসাভার। এই সুযোগ মিস করার প্রশ্নই আসে না। এক বাক্যে রাজী- তবে পরের পার্ট টা শুনে একটু দমে গেলাম সেটা হল আমি গেলে যেতে হবে গল্প লেখক হিসেবে। মানে আঁকিয়েদের কোটা নাকি ভরে গেছে, সিট খালি নাই। যাই হোক কোন এক ফন্দি ফিকির করে সেটা ম্যানেজ করা যাবে ভেবে এক বাক্যে রাজী হয়ে গেলাম। নির্ধারিত দিনে এক দঙ্গল গম্ভীর মুখের শহরে বিভিন্ন ক্রিয়েটিভ বিজ্ঞাপন ফার্ম এর কপি রাইটারদের সাথে আমাকে হাসিমুখে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে দেখা গেলো- সামনে নেমপ্লেট, মেহেদী হক, রাইটার। (দেশ এইভাবেই চলছে) প্রথম দিনেই আমি মহা মুগ্ধ। তখনো রামমোহন আসেন নি।, এমনকি না আসারও ক্ষীণ সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে। এসেছেন দীপা ভালসাভার নামের একজন চমৎকার মহিলা। আমি প্রথম দিনেই তাঁর ভক্ত হয় গেলাম। ভারতের একজন বিখ্যাত চিলড্রেন বুক রাইটার তিনি, বেশ কিছু এক্সপেরিমেন্টাল টেক্সট বুকও লিখেছেন। আর সেই সাথে ইউনিসেফ এর একজন নীতিনির্ধারনী কনসাল্টেন্ট ও তিনি। তারপরেও কি চমৎকার সাবলীল আর সাধারণ মানুষ। সত্যিকারের কয়েক প্রজন্ম শিক্ষিত হলেই বোধহয় এমন বিনয়ী হওয়া সম্ভব। প্রথম দিনেই আমি বুঝে গেলাম লেখক হিসেবে ঢুকে কি ভালো কাজটাই না করেছি। কারণ আঁকাআঁকির চাইতে গল্প কিভাবে বলতে হয় আর সেটা যে মেথডিক্যালি শেখারো ব্যাপার সেটা এইখানে না এলে বুঝতাম না। এই মূহুর্তে কমিক্স এর গল্প লিখতে সেই কয়েকদিনের রসদই মূল কাজটা চালাচ্ছে। যাই হোক, মীনা এবার তিনটা মেসেজ দিবে তার দর্শকদের। একটা হল খাবার আগে হাত ধোয়া, আরেকটা হল নবজাতকের জন্মকালীন যত্ন, আর হল সুষম খাবার যাতে বাচ্চারা খায়- ইত্যাদি। প্রতিটা বিষয়েই কনসেপ্ট ডেভেলপের জন্যে এবার আমাদের চারজন চারজন করে কয়েকটা গ্রুপ এ ভাগ করা হল। আমার গ্রুপ পড়লেন টুশি আপু (দেশ টিভিতে তখন দূরপাঠ এর উপস্থাপনা করতেন, আসর জমানো মজার মানুষ), নাফিস ভাই (অগিলভি তে কাজ করেন-আমার দেখা দারুণ ভদ্রলোকের একজন) আমি আর মেহের নিগার আপা (উনি এক স্কুলের গম্ভীর ম্যাডাম কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখেছি ওনার মত কজন সিনিয়র যিনি একাধারে মা ও শিক্ষিকা- তিনি আসলে এ ধরনের প্রজেক্ট এ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি।) লটারিতে আমাদের গ্রুপের ভাগে পড়লো হাত ধোয়া। এবং আল্লা মাফ করুন তার পর টানা দুইদিন কেন হাত ধুতে হবে এবং সেটা কিভাবে তার উপর একের পর এক বিশেষজ্ঞ ও ডাক্তার পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন শুরু করলেন। এবং সেই পাওয়ার পয়েন্টের গ্রাফিক্স এ তাঁদের সমস্ত প্রতিভা ঢেলে দেয়া কোনটার প্রতিটা শব্দ এনিমেট করে ঘুরতে ঘুরতে আসে, কোনটা ব্লার ইন করে ঢোকে। হাত ধোয়া নিয়ে শুনতে শুনতে পারলে দুই হাত কেটে ফেলি এই টাইপ অবস্থা। আমার চেনাজানা একজনই ছিলো- উন্মাদের অনুজ কলিগ স্পন্দন সে বুদ্ধিমানের মত প্রথম দিন মুখচোখ সিরিয়াস করে বসে থেকে পরেরদিনই ভাগলো। দ্বিতীয় দিনে আমি ওয়ান টাইম চামচ হাত ধোয়ার বিকল্প হতে পারে কি না সেটা ইউনিসেফের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর পেলাম না। যাই হোক। দ্বিতীয় দিনেও সকাল থেকে যখন আবার নবজাতকের পরিচর্যায় কী কী করতে হয় তার প্রেজেন্টেশন শুরু হোল তখন আমি আর নাফিস ভাই চা খাওয়ার কথা বলে ভাগলাম। দু'জনেই মেজাজ খারাপ করে নীচে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি। উনি অনেক ভদ্রলোক তাই বললেন এরকম একটু হবেই। আমি সাফ বলে দিলাম ভাই আপনারা করেন, আমি এত ক্রিয়েটিভ না, আমি গেলাম। কিন্তু উনি জানালেন সামনে নাকি রামমোহন আসবেন। বাস এক কথায় চুপ। আর সেটাতে উনিও ঢুকবার তালে আছেন। বিনা বাক্যব্যয়ে ওপরে এসে 'হাত ধুয়ে' লাঞ্চ এ বসলাম। এরপর আসলেই স্টোরি লেখার কাজ। মানে যার যা ইচ্ছা তাই বা যাচ্ছেতাই লেখা। আমাদের গ্রুপ এ আমরা বসেই প্রত্যেকে যার যার মত করে আইডিয়া ভাবতে লাগলাম। এবং শেষে এসে আমার একটা ছোট আইডিয়া সবারই ভালো লাগায় সেটাই আরেকটু ডেভেলপ করে দেয়া হল। এর পর রিভিউ সেশন, সেখানে দীপা আমাদের গল্পটা দারুণ পছন্দ করলেন। এবং তারপর দেখলাম আসল মজা। সত্যিকারের একজন লেখক কিভাবে লেখেন ও গল্প বলেন তা টের পেলাম। আমাদের একেবারে সাদামাটা গল্পটা উনি এক ঘষায় একেবারে চমৎকার করে দিলেন। মানে যেখানে একটু ঝুলে গিয়েছিলো সেখানে অদ্ভূত ফান যোগ করলেন। যেখানে ঘটানাটা 'বিশ্বাসযোগ্য' হচ্ছিলো না সেখানে বিশ্বাসযোগ্য কিভাবে করা যায় সেটা বললেন। আর সব শেষে মূল মেসেজটা ঠিকভাবে যাচ্ছে কিনা তা ঠিকঠাক করে দিলেন। প্রথমবারের মত একটা টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কিভাবে গল্প বানানো যায় তা দেখলাম। এবং দীপা জানালেন আমাদের গল্পটা ভালো। কারণ এটায় কিছু নতুন এলিমেন্ট আছে যা মীনা তে ছিলো না। মীনার আগের সব গল্প কিছুটা গোপাল বড় ভালো ছেলে টাইপ। এবং খুবই স্লো ফ্রেম রেট এ গল্প এগিয়েছে। এখানে ব্যাপারটা আলাদা। আমাদের সবার থেকে তাই যে ক'টা গল্প নেয়া হোল তার মধ্যে এটাও একটা। এবং ওয়ার্কশপ এর প্রথম পার্ট এভাবেই শেষ হল! মানে রামমোহন পর্ব এবার না :( । 

এরপর সেই অগাস্টেই-ততদিনে রোজা শুরু হয়ে গেছে বলে মনে পড়ছে। আবার ডাক এলো। এবং হ্যাঁ এবারে সত্যি সত্যি রামমোহন এসেছেন। কিন্তু আমি আবার সেই লেখক টিম এ। এবারে আর সম্ভব না। দীপা এবং পুলকদা' (পুলক রাহা আর মীরা মিত্রা ছিলেন এই পুরো আয়োজনের কো- অর্ডিনেটর হিসেবে) কে ধরে বলে কয়ে এক শর্তে সেই অনুমতি মিললো সেটা হল আরেকজন কোন লেখককে দিয়ে যেতে হবে রিপ্লেস হিসেবে। সাথা সাথে জানালাম খুব ভালো একজন লেখক আছেন। তাঁর নাম মিতু (বলাই বাহুল্য সে আমাদের কার্টুনিস্ট মিতু)। যথাসময়ে মিতুকে লেখদের গ্রুপে বসিয়ে চলে গেলাম রামমোহনের সাথে। এবং সেই গল্পে আসলেই সে বেশ কিছু দারুণ সংযোজন করেছে যেগুলি দীপা এড করে দিয়েছিলেন। রামমোহন পর্ব নিয়ে এই ব্লগেই আরো একটা লেখা লিখেছি তাই সেটা আর বড় না করি সেটা পড়তে পাবেন এখানে 

যাই হোক অভিনব যে ব্যাপারটা ঘটলো সেটা হল আমি আর নাফিস ভাই আমাদের ওই গল্পটাই আবার গিয়ে ড্রয়িং সেশন এ গিয়ে পেলাম মানে নিজেদের গল্পের ক্যারেক্টার ডিজাইন আর এনভায়রন্মেন্ট ডিজাইন নিজেরাই করার একটা সুযোগ ঘটলো এবং সেটা আবার কিংবদন্তী রামমোহনের তত্ত্বাবধানে! এবং শেষে দেখা গেলো আসলে গল্প ক্যারেক্টার শেষে আমরা এমনকী জোশের ঠেলায় স্টোরিবোর্ডিং ও করে দিলাম। মানে পুরো কমপ্লিট স্কৃপ্ট। আমার জন্যে অসাধারণ অভিজ্ঞতা। কারণ এই সাইড টা নিয়ে আমার তেমন কোন আইডিয়াই ছিলো না। আমি এঁকেছি পলিটিক্যাল কার্টুন আর এঁকেছি উন্মাদের ফিচার। পুরোদস্তুর এনিমেশন শর্টফিল্ম এর সাথে কাজ করবো সেটা ভাবি নি। সেই সেশনে বাংলাদেশের বেস্ট এনিমেটরদের সাথে পরিচয় হোল। অপু ভাই, সুদি ভাই, ক্লিক হাউজের তমাল ভাই, আশীষদা', তৌফিক ভাই, সাব্বির ভাই আরো কতজন সবার নাম এই চার বছর পর মনেও নেই। 

যাই হোক সেই সেশন শেষে সবাই বাড়ি ফিরলাম এবং বলা হল যার যার গল্প নিয়ে এনিমেশন হবে তাদেরকে জানানো হবে।  আমাদের গল্পটা নিশ্চিতভাবে এনিমেটেড হচ্ছে। আর সেটা করবে ক্লিক হাউজ এনিমেশন। এবং যেহেতু গল্পটার প্লট এবং ক্যারেক্টার ডিজাইনের সাথে আমি জড়িত ছিলাম সেহেতু রামমোহন স্যার এবং ইউনিসেফ থেকে মীরাদি' বলে দিলেন যাতে এই প্রজেক্ট এ ক্লিক হাউজ থেকে আমাকে শর্ট টার্ম কন্সালটেন্ট হিসেবে নেয়া হয় (যদিও পরে তারা নিজেদের প্রতিভা দিয়েই কাজটা শেষ করেছে)। এরপর থেকে মাঝে মাঝেই আমি খোঁজ নিতাম যে কার্টুনের কতদূর। খালি জানতাম যে হচ্ছে, কাজ চলছে ইত্যাদি। কিন্তু আসলে কবে হবে বা আদৌ হবে কি না তা বুঝতে পারছিলাম না। এমন করে করে বছরের উপরে চলে যাবার পরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে পুরো ব্যাপারটাই ভুলে গেলাম। অনেকদিন পরে শুনি মীনার নতুন সিরিজ চলছে। খোঁজ নিলাম- না আমাদেরটা না। আবার শুনি আরেকটা চলছে এবারেও সেই কাহিনীটা না। এভাবে চার বছর চলে গেলো। আমি সেই প্রজেক্টের কথা আসলেই ভুলে বসে আছি। সেদিন ঢাকা কমিক্স এর কাজে ব্র্যাক এর মেহেদী সাজ্জাদ ভাইয়ের কাছে গিয়েছি এমন সময় উনি হঠাৎ বললেন- আপনি কি মীনা সিরিজের কোন গল্প লিখেছেন? আমি অবাক। উনি জানালেন ওনার বাচ্চার দেখার জন্যে মীনার নতুন কছু সিরিজ উনি ইউটিউব থেকে নামিয়েছেন সেখানে একটার ক্রেডিট লাইনে আমার নাম দেখেছেন। কি বিস্ময়! তারমানে সেটা বের হয়েছে? আমি জানিও না। সেই মূহুর্তে মেহেদী সাজ্জাদ ভাইয়ের ট্যাব এ ভিডিও ক্লিপটা চালু হল- আমার আঁকা প্রথম সিন! একদল ভাইরাস আতংকে ছুটছে পেছনে পানির তোড়...রীতিমত আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। আর কান্নাকাটি না বাড়িয়ে ভিডিওটা তুলে দেই। স্ট্যান্ডার্ড না হলেও আমার এক্সপেকটেশনের তুলনায় ক্লিক হাউজ ভালো কাজ করেছে সেজন্যে তাদের ধন্যবাদ। একটা কাজ এর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত থকে সেটার এন্ড প্রডাক্ট দেখতে পারার অনুভূতি আসলেই অতূলনীয়। ধন্যবাদ ইউনিসেফ, ধন্যবাদ রামমোহন এবং ধন্যবাদ মীরাদি' পুলকদা' ও মিল্কি ভাই কে (যার নাম এতক্ষণ বলি-ই নাই, একমাত্র মিল্কি ভাইয়ের সাথেই বরং এই চার বছরে আমার টানা যোগাযোগ আছে।) 

পুনশচঃ ওয়ার্কশপের শেষ দিনে লিফট এ উঠতে যাব এমন সময় গম্ভীর মুখের হ্যাংলাপানা একজন লিফট এ উঠলেন এবং লিফট এ যে আমিও আছি সেটা তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো না। পরে দেখি উনি রামমোহনের সাথে গুজগাজ করছেন। অপু ভাই জানালেন ইনি সব্যসাচী মিস্ত্রী- আমি বিমোহিত। ওই মূহুর্তেই তাঁর একটা ক্যারিকেচার করে দিলাম উনি গম্ভীর মুখে কথা না বলে সেটা ব্যাগে ঢুকিয় আবার রামমোহনের সাথে কথা শুরু করলেন। একটু দমে গেলাম। তার এক বছর পরেই তাঁর সাথে আমার খুবই গুরুশিষ্যসুলভ সম্পর্ক শুরু হোল। এক ফাঁকে আমি জানতে চাইলাম ওইদিন অমন করলেন ক্যান? উনি জবাব দিলেন 'আমি জানতাম তুই চারুকলার' । কথাটার ব্যাখ্যা বুঝি নাই কিন্তু চারুকলায় না পড়ার জন্যে একটু লাকি মনে হল নিজেকে :) ।




2 comments:

  1. শুধু কার্টুন নয়, আপনার লেখাও বেশ ভালো লাগে।

    ReplyDelete

হ্যাংওভার কাটিয়ে

একটা সময় ছিল সব জায়গায় লেখা থাকতো (অবশ্যই এখনো আছে) 'রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ'। এখন অবস্থা উলটো। এখন যেন রাজনীতি ছাড়া অন্য আলাপ জমেই না। ...