নিউ এইজ অফিস থেকে বের হয় সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে তেজগাঁ সাত রাস্তায় পৌঁছলাম। গন্তব্য উত্তরার গ্যালারি কায়া। সেখানে বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট এসোসিয়েশনের অন্যতম উপদেষ্টা কার্টুনিস্ট শাহরিয়ার ভাইয়ের রাজনৈতিক কার্টুনপ্রদর্শনী চলছে। শুরুর দিনেই তাঁর ফোন পেয়েছিলাম কিন্তু সেদিন পারিবারিক কাজে ঢাকার বাইরে রওনা দেবার কারণে আর সেখানে যাওয়া হয় নি। অবশেষে সুযোগ হল প্রদর্শনীতে যাবার।
আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ভক্ত। তার প্রধান কারণ তাঁর কিছু বক্তব্য। আমরা বাংলাদেশের কার্টুনিস্টদের নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করতে ২০১৩ সালের নভেম্বার এ তাঁর ডেইলি স্টার এর অফিসে গিয়েছিলাম। উনি প্রথমেই কোনরকম সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকৃতি জানান। এবং কেন উনি বাংলাদেশের সমগ্র তরুণ কার্টুনিস্টকুলের অপর বিরক্ত তার কিছু পয়েন্ট বলেন। আমি তাঁকে বলি যাতে এইগুলি-ই উনি সাক্ষাৎকারের বদলে বক্তব্য হিসেবে ক্যামেরার সামনে বলেন। তাঁর মূল বক্তব্য ছিল-
বাংলাদেশের তরুণ কার্টুনিস্ট রা অনেক কম আঁকে। উনি নিজে ডেইলি স্টারের সিটি এডিটর- এমন কি পেশাদার কার্টুনিস্ট ও বলা যাবে না তাঁকে, কিন্তু তাঁর যে পরিমাণ কাজ মূল ধারায় হচ্ছে, আমরা যারা তথাকথিত মূলধারা তারা তো এর ১০ আগের এক ভাগ ও আঁকি না। এবং এভাবে সপ্তাহে দুই তিনটা কার্টুন করে কোন 'মার্কেট ইম্প্যাক্ট' পড়বে না। টুকুর টাকুর করে দুইটা এঁকে বাহবা কুড়ানোর বদলে তাঁর ইচ্ছা মরার আগে এক শেলফ ভর্তি নিজের আঁকা কাজ রেখে যাওয়া।
এই কথাগুলি আসলে কতটা সত্য তা যতই দিন যাচ্ছে টের পাচ্ছি। জিনিয়াসদের কথা আলাদা। তারা হয়ত জীবনে দুইটা কাজ করেই অমর হয়ে যাবেন। বা ভালো কাজ ছাড়া করবেন না। কিন্তু আমি মনে করি আমরা যারা জিনিয়াস না তাদের মানুষের কাছে পৌঁছানোর বা মার্কেটে থাকার একমাত্র উপায় হল কাজের পরিমাণ। এখানে কার্টুনিস্ট আর্টিস্টদের একটা কমন ট্র্যাপ আছে। তারা টাকা পয়সা কামানোর জন্যেই এমন অনেক কাজ করতে বাধ্য হন যা আসলে তার নিজের পোর্টফোলিওতে যোগ হয় না। বিভিন্ন কম্পানীর কমার্শিয়াল আঁকা এড ফার্ম অথবা এনজিও'র প্রমোশনাল কাজ। দুঃখের বিষয় এগুলিতে টাকা পেলেও আসলে বছর দশেক পরে তারা টের পান যে নিজেদের কোন সৃষ্টি বা ব্র্যান্ডিং তাদের নেই। যেই ব্র্যান্ডিং তৈরী করতে চাইলে আসলে নিজের মনের মত করে একটা নিজের কিছু করা উচিত ছিল। যেমন টা করেছেন কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব (উন্মাদ) করেছেন কার্টুনিস্ট শিল্পী রফিকুন নবী (টোকাই), এবং করেছেন কার্টুনিস্ট শাহরিয়ার (বেসিক আলী, বাবু) এখানেই এঁরা আলাদা। তাঁরা জীবনে আর কিছু না করলেও তাঁদের এই কারণেই ইতিহাসে লিখে রাখতে হবে। (তবে শুধু পলিটিক্যাল কার্টুন আঁকিয়েদের তাই বলে ফেলে দিতে হবে তা অবশ্যই না, পার্টিজান আচরণ আমলে না নিলে কার্টুনিস্ট হিসেবে অনেক ওপরে রেখে দিতে হবে কার্টুনিস্ট আসিফুল হুদা কে) এবং শুধু তা-ই না। তাঁদের সেই কাজের ভলিউম আমরা যারা ফুল টাইম কার্টুনিস্ট তারা দিনরাত এঁকেও ছুঁতে পারি না।
আমি মনে করি রাজনৈতিক কার্টুনের চেয়ে কার্টুনিস্ট শাহরিয়ার এর অবদান অবশ্যই কমিক্স এ অনেক বেশী। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক কার্টুন যে কারণে অনন্য সেটা সেদিন গ্যালারি কায়া তে গিয়ে আরো নিঃসন্দেহ হলাম। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ আমাদের কার্টুন (অংকন) শিল্পে একটি 'শিশির ভট্টাচার্য' প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত থাকা। আশির দশকে রাজনৈতিক কার্টুনকে একটানে একেবারে অনেক ওপরে তুলে ফেলার কারিগর শিশির স্যার ইতিমধ্যে এ দেশের কিংবদন্তীতূল্য হয়ে গেছেন। কিন্তু একইভাবে উনি অনিচ্ছাকৃত যে সমস্যার তৈরী করেছেন সেটা হল এমন একটা ড্রয়িং মানদণ্ড বানিয়ে দিয়েছেন যাতে করে কার্টুনের আইডিয়া ছাপিয়ে ড্রয়িং এর দিকেই পাঠকের চোখ আটকে থাকে। তাঁর অসাধারণ কিছু কার্টুনেও পাঠকেরা তাই প্রথমে ড্রয়িং এর সুনাম করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে অপেক্ষাকৃত নতুন কার্টুনিস্ট রা অবচেতনেই তাঁকে হুবহু অনুকরণের চেষ্টা করতে থাকে। এমনকী পত্রিকার সম্পাদকদেরকেও বলতে শোনা যায়- শিশিরের মত করে আঁকেন। এ ক্ষেত্রে অনেক ভুলেই যায় যে কার্টুন মানে আসলে প্রথমে আইডিয়া পরে সাপোর্টিভ ড্রয়িং। এবং তাঁর প্রভাব এতই ব্যাপক ছিল যে সেই বলয় মোটামুটি দশ বছর সবাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এর থেকে একটা বড় রিলিফ আমরা পাই কার্টুনিস্ট শাহরিয়ার এর রাজনৈতিক কার্টুনে। সিমপ্লিসিটি আর একই সাথে সরল স্যাটায়ার ফানটাই তখন মূখ্য হয়ে পড়ে। আরো একটা ব্যাপারের একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা মনে এল। যদিও কার্টুনে ডায়ালগ বা টেক্সট এর অতি ব্যবহার কাম্য নয়। কিন্তু আমি মনে করি কার্টুন যে শুধু একটা ফিলার আইটেম না এটা বোঝাতে কিছুটা লেখালেখি এটাকে আলাদা ফিচার হিসেবে বরং শক্ত অবস্থান দেয়। শাহরিয়ার এর কার্টুন এ আমরা এই ধরনের সংলাপ ভিত্তিক কয়েক লেয়ার এর আইডিয়া দেখি। মূল চরিত্র হিসেবে হাসিন বা খালেদা একে অন্যের গুষ্টি উদ্বার এ থাকলেও আশে পাশে তাকালেই ফালু, জয় বা তারেক কেও খুঁজে পাওয়া যায়। এবং তারাও কার্টুনের একটিভ চরিত্র। হাসিনার চেয়ার এর আশে পাশে মাঝে মাঝেই ইউনুস এর সূঁই ফুঁড়ে রাখা ভুডু ডল খুঁজে পাওয়া যায়। তারেক কে দেখা যায় ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দন্তবিকাশমান হিসেবে। মানে একটা কার্টুন দর্শকেরা বেশ খানিকটা সময় নিয়ে দেখতে পারেন। তাঁর কার্টুনের কারিগরি দিক থেকে বলা যায় আমাদের নিউজপেপার প্রিন্ট এর কথা মাথায় রেখে পেশাদারি ডিজিটাল কালারিং তাঁর আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য। কোবাল্ট ব্লু ব্যকগ্রাউইন্ডে ওয়ার্ম ইয়েলো বা অরেঞ্জ এ কার্টুন ফ্রেন্ডলি রঙের ব্যবহার টা চোখে আরাম দেয়। রিডেবিলিটি কোথাও হারায় না। ভ্যালু নিয়েও ঘাপলা নেই। লাইট শেড এর বাড়াবাড়িও নেই। বোঝার জন্যে যেটুকু দরকার সেটুকুই আছে। সব মিলে তাঁর রাজনৈতিক কার্টুন বেশ মজাদার। আর কার্টুনের সেটাই প্রথম দাবী।
প্রদর্শনী থেকে ফিরে আসতে আসতে সেই কথাগুলি আবার মাথায় নেড়েচেড়ে দেখলাম- কাজের ইম্প্যাক্ট ফেলতে ভলিউম কতটা জরুরী। আমাদের সিনিয়ররা যা করে গেছেন এবং করে যাচ্ছেন আমরা এই পূর্ণ যৌবনে কেন যেন তার ধারে কাছে যাবার আগেই ভেবে ফেলছি বিরাট কিছু করে ফেলেছি। চার পাঁচটা কার্টুন এঁকে সেটার প্রচার করছি আরো বেশী, সাক্ষাতকারের সংখ্যা হচ্ছে বইয়ের চেয়ে বেশী। আঁকার আগেই কিভাবে 'লাইক' বাড়ানো যায় সেটা ভাবছি, অথবা সময় কাটাচ্ছি অন্যরা কত ফালতু সেটা নিয়ে গুলতানী মেরে। ইন্টারনেটে এই যুগেও আমরা যারা কূয়োর ব্যাং তাদের জন্যে ইতিহাসের করুণা ছাড়া দেবার আর কিছুই থাকবে না আসলে। সেটা শুধু কার্টুন না- সব ক্ষেত্রেই।
এই বছর তাই নিজেকে ফাঁকি না দেবার প্রতিজ্ঞায় বাড্ডাগামী তুরাগ সার্ভিসের বাসটায় উঠলাম।
গ্যালারি কায়ায় কার্টুনিস্ট শাহরিয়ার এর কার্টুন |
আরেকটা মজার জিনিস ছিল তাঁর অরিজিন্যাল কপি। উনি প্রায় ১৫০% সাইজ বড় করে আঁকেন। |
আরো কার্টুন |
প্রদর্শনীর দর্শক হিসেবে আমার বন্ধু মহলকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে টেনে এনেছিলাম, বাঁ থেকে আফতাব (এর একটু পরেই সে সুইটজারল্যান্ড এ চলে যায় একমাসের জন্য), শহীদ, পিছনে সাকিব, সামনে আমি। |
শেষ মূহুর্তে প্রদর্শনী দেখতে পেরে মুখব্যাদানরত |
অসাধারণ লাগলো ভাইয়া... আমি নিজে এমনিতেই আঁকতে পারিনা... কিন্তু মাঝেমাঝে একদিন গুতাগুতি করে যা আঁকি তা ফেবুতে আপলোড করে তার ফিডব্যাক নিতে দিতেই তিনচারদিন ব্যয় করে ফেলি আর আঁকার আগেই আপলোডের চিন্তা করি... এই চক্কর থেকে বের হওয়ার জন্য কিছুদিনের জন্য ফেবু ছেরে দিয়েছি আর প্র্যাকটিস করছি প্রত্যেকদিনই কিছু না কিছু... কার্টুন আঁকিবার ক খ গ এবং ক্ষ থেকে তো শিখছিই এরপরও পিন্টারেস্ট, ইউটিউব আর আপনার ব্লগে পাওয়া ইলিমেন্ট গুলো নিয়ে গুতাই কাজের ফাঁকে প্রতিদিনই। দোয়া রাখবেন আর আপনার হেল্প তো প্রতিনিয়তই পাচ্ছি... আপনি আমার গুরু :)
ReplyDelete:D
ReplyDeleteকার্টুন আঁকিবার ক খ গ এবং ক্ষ তে আপনার ব্লগের ঠিকানাটা ভুল আছে। "মে হেহে দি" হয়ে আছে।
ReplyDelete