ব্লগে একেবারেই অনিয়মিত ছিলাম প্রায় এক বছর। এবারে ভাবছি অন্তত প্রতি সপ্তাহে একটা জনসেবামূলক পোস্ট দেব। তার একটা আজ দেয়া যাক। সবচেয়ে বেশী যেটা লেখার জন্যে বারবার ট্যালেন্টেড আঁকিয়েকূল অনুরোধ করেছে সেটাই ধরি। বাংলাদেশে কার্টুন-ইলাস্ট্রেশন ক্যারিয়ার আসলে কতটুকু সম্ভাবনাময় এবং সেদিকে এগোনোর ভাল উপায় কী?
প্রথমেই বলে রাখি- বেশী উত্তেজিত না হওয়া ভাল। সত্যি কথা হল যে পরিমাণ সম্ভাবনাময় ভালো ভালো আঁকিয়ে এই মুহূর্তে আছে বা তৈরী হচ্ছে, বাংলাদেশের মার্কেটে এই সেক্টরে অত চাকরি নাই। এটা আগে বুঝে নিতে হবে। তবে চাকরির বাইরে যদি কাজের কথা বলা হয় তবে অফুরন্ত কাজের সম্ভাবনা আছে। স্ট্রাগলিং আঁকিয়েদের এগোনোর ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হয়ে, আমি সংক্ষেপে কী করিলে কিভাবে এগোতে পারিবেন সেটা লিখে দেই- ক্যাজুয়ালি,
১. আঁকুন ও দেখান
এর কোন বিকল্প নেই। প্রথমত আঁকা শিখতে হবে। সেটা ভাল না হলে পরের কিছু আর পড়ে লাভ নেই। তবে এটা একটা ধারাবাহিক যাত্রা। আজকে যেটা মনে হবে মাস্টারপিস এঁকেছি এক বছর পরে সেটা কাউকে দেখাতে যদি লজ্জ্বা না লাগে বুঝতে হবে আপনি আটকে গেছেন আর নিজেই নিজের কাজে মুগ্ধ হয়ে পড়েছেন। শিখব কোথায় এই প্রশ্ন এখন করার মানে নাই। অনলাইনে এখন দুনিয়া খোলা। চাইলে পৃথিবীবিখ্যাত আর্ট স্কুলগুলির অনলাইন কোর্সে ভর্তি হোন। ইউটউবে দেখুন টিউটোরিয়াল, বই পড়ে স্টাডি করুন। স্কেচবুক নিয়ে বের হয়ে যান পছন্দের বিষয় স্টাডি করতে। আর এরপরের যেটা সেটা হল- সেটা অন্যদের দেখান। তবে এইটা সবথেকে টৃকি পার্ট। আপনি অসাধারণ আঁকেন কিন্তু কেউ জানে না তাহলে লাভ নেই। যেভাবে পারেন আশেপাশের মাধ্যম ব্যবহার করুন। ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ব্লগ, টাম্বলার যেটাতে আপনার দর্শক বেশী সেটাতেই শেয়ার করুন। তবে সাবধান। মানুষের বিরক্তির কারণ হবার দরকার নেই। আজ বিশেষ দিবস, সবাই ফেইসবুকে কিছু একটা দিচ্ছে, তাহলে আমারো কিছু একটা না দিলেই না, এটা কোন আর্টিস্টের কথা না। আঁকুন নিজের তাড়না থেকে। আর কখনই-প্লিজ লাইক মাই পেইজ, যদি ভালো লেগে থাকে শেয়ার করুন- এইগুলি বলবেন না। কারো ভালো লাগলে সে এমনিতেই সেটা প্রচার করবে। কাজ ভাল করুন। সেটা ছড়াবেই। 'লাইক দিন' বলা মাত্র আপনি আসলে সস্তা হয়ে যাবেন। মানুষ আপনাকে আরো দশটা ফেইম সিকারের সাথে গুলিয়ে ফেলবে। এখানে ছ্যাবলামি আর স্মার্ট মার্কেটিং এর মাঝে একটা ফাইন লাইন আছে। সেটা মেনে চললেই হয়।
যেমন Jake Parker সেদিন তাঁর একটা ইউটিউব ভিডিও ছাড়লেন। সেখানে তাঁর স্কাইহার্ট নামের একটা বিরাট গ্রাফিক নভেল তিনি কিভাবে এঁকে শেষ করেছেন সেটা জানালেন। এবং শেষে বললেন,
ইউটিউবে আমি অনিয়মিত। কারণ শুধুমাত্র কন্টেন্ট দিতে হবে বলে একটা কিছু বানিয়ে পোসট করা মানে ভক্তদের সময় নষ্ট করা, আমি যদি সত্যি ই গুরুত্বপূর্ণ বলে কিছু জানানোর আছে মনে করি শুধু তখনই কিছু একটা পোস্ট করি।
সুতরাং প্রচারের ক্ষেত্রে এটা খুবই সাবধানে হ্যান্ডল করার বিষয়, মানুষের বিরক্তির কারণ হবার চাইতে প্রচার না করে কাজ শেখা বরং ভালো।
২. বড় কোন আর্টিস্টকে গুরু ধরুন
শিল্পকলা মূলতঃ গুরুমুখী বিদ্যা। গুরু বলতে সেই সত্য যুগের যোগী কাউকে ধরার কথা বলা হচ্ছে না। যেখানে গুরুর পায়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকে জীবন যৌবন শেষ করে গুরুদক্ষিণা গুণতে হবে শেষে। এমন কোন আর্টিস্টের সাথে সাথে থাকুন যিনি অন্তত আপনার চেয়ে ভালো আঁকেন, এবং মানুষ হিসেবে ভালো। এই জিনিসটা কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ভালো আঁকিয়ে কিন্তু ভিতরে ভিতরে ছোটোলোক ধরনের, এমন মানুষ এড়িয়ে চলাই ভালো। সবসময় নিজের চেয়ে ভালো আঁকিয়েদের সংস্পর্শে থাকলে ভিতরে একটা তাড়না কাজ করবে যে আমাকে আরো ভালো করতে হবে।
অনেক ক্ষেত্রেই বরং উল্টোটা দেখা যায়। সাধারণতঃ ফাঁকিবাজ আঁকিয়েরা ঘোরাঘুরি করে তার চেয়ে পঁচা আর্টিস্টদের সাথে যাতে নিজেকে তাদের চাইতে বড় আঁকিয়ে মনে হয়! আর যদি মনে হয় আমার চাইতে বড় আর্টিস্ট তো দেশে দেখি না। ভাল কথা, তাহলে বাইরের দেশে খুঁজুন। মাস্টার আঁকিয়েদের তালিকা গুণে শেষ হবে না।
৩. ভিজিটিং কার্ড ও ওয়েবসাইট বানান
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাঝে মাঝেই আউ-ফাউ কিছু মিটিং বা সেমিনারে যাওয়া পড়বে, চেষ্টা করুন সেখানে মানুষের সাথে পরিচিত হতে। জোর করে না, যাকে সমমনা মনে হবে আর কি। এসব জায়গায় কথা শেষে বাড়িয়ে দিন নিজের ভিজিটিং কার্ডটা। আর যেহেতু আঁকেন, সেহেতু নিজের একটা গ্রাাফিক্স বা ড্রয়িং সেখানে থাকলে ভাল। তবে নিজের চৌদ্দটা ডেজিগনেশন বানিয়ে হাসির পাত্র না হয়ে সিম্পল একটা অকুপেশন লিখুন, যদি কার্টুন আঁকেন তবে লিখুন 'কার্টুনিস্ট'। যদি এনিমেশন
করেন তবে লিখুন 'এনিমেটর'। আপনি যে মাঝে মাঝে বাঁশিও বাজান সেটা লেখার দরকার
নাই। । সেই সাথে পারলে তাঁর কার্ডটাও নিন, সংগ্রহ করুন। কার্ড রাখার একটা এলবাম কিনে নিন। ট্রাস্ট মি, এটা কাজে লাগবেই। এটার মানে কিন্তু এই না যে যার সাথেই দেখা হবে কার্ড দিয়ে বলবেন যে,
-ভাই আমারে কাজ দ্যান।
এটার মানে নেটওয়ার্ক বানানো। এরকম ১০০ মানুষের সাথে আপনার যোগাযোগ থাকলে দেখবেন কিছু মানুষ কাজের সময় আপনার কথা ভাববে। মানুষের সাথে মিশুন আন্তরিক ভাবে। শুধু কাজ দিবে ভেবে মেশার মত ছ্যাবলামি করলে আপনি একটা ধান্দাবাজ ছাড়া আর কিছু হবেন না। যাদের ভাল লাগে তাদের সাথে মিশুন, কথা বলুন। কাজ পান বা না পান এই সম্পর্কগুলি-ই জীবনের একটা ট্রেজার।
ভাল কথা, ফেইসবুক পেইজ যাদের আছে সেটা খুব ভালো কথা, কিন্তু একটা ওয়েবসাইট থাকা খুবই জরুরি। কারণ ফেইসবুক পেইজ খুবই ইনফর্মাল একটা জিনিস। আসল সিরিয়াস ক্লায়েন্ট আপনার ফেইসবুক পেইজ দেখতে অতটা সস্তি বোধ করবে না। আর দেশের বাইরে যে কেউ আপনি আসলে কতটূকু প্রফেশনাল সেটা জানতে আগে খুঁজবে আপনার ওয়েবসাইট। সুতরাং বেশ ভাল দেখতে একটা ওয়েবসাইট করুন, সেটার এড্রেস রাখুন ভিজিটিং কার্ডে।
৪. পোর্টফোলিও রাখুন সাথে
যে কোন ক্লায়েন্ট মিটিং এ সাথে নিজের কাজ রাখুন। নিজেকে যতটা সেলিব্রেটি ভাবেন আসলে আপনি অতটা নন যে ক্লায়েন্ট আপনার চেহারা দেখেই বলবে- আরেহ্, আপনি?
রিয়েলিটি হল, ক্লায়েন্ট প্রথমেই আপনি কাজটা পারবেন কিনা সেটা দেখতে চাইবে আপনার স্যম্পল কাজ দেখে। আমার মতে সবথেকে স্মার্ট উপায় হল একটা ট্যাব রাখা। মোবাইলে কিছু দেখালে খুব সস্তা দেখায়, মনে হয় বন্ধুকে কিছু একটা দেখাচ্ছেন। তার চেয়ে একটা ইঞ্চি দশেক ট্যাবে আপনার সাম্প্রতিক কাজ রাখুন, চাইলে একটা পিডিএফ করে রাখুন। কথার সময় প্রাসঙ্গিক হলে আপনার কাজ দেখান। একগাদা পেপার কাটিং নিয়ে যাওয়াটা একটু 'ইয়ে' হয়ে যাবে, আর ট্যাবটা ক্যাজুয়ালি বের করা ভাল যাতে বোঝা যায় শুধু ক্লায়েন্টকে দেখাতে না, আপনি অন্য কাজেও এটা ব্যবহার করে থাকেন।
আর ট্যাব দামি বা আনা ঝক্কি ভাবলে একটা স্কেচবুক রাখুন, যেখানে অন্তত কিছু আঁকা ভবেচিন্তে করা, মানে ক্লায়েন্ট দেখবে এটা ভেবেই করা।
৫. সমাজে থাকুন
আমি বিরাট আর্টিস্ট তাই একা একা থাকি- এটা বোকাদের কথা। একা একা মানুষ থাকলে সে বোকা বোকা হয়ে যায়। ভাবে সে-ই পৃথিবীর কেন্দ্রে। সবেথেকে ভাল হয় সমমনা দারুণ কাজ করে যারা তাদের নিয়ে থাকা, তাদের সাথে থাকা। সবসময় আঁকতেই হবে এমন না। আড্ডা দেওয়াও একটা জরুরি কাজ। এবং এভাবেই বেশ কিছু আপনার কাজের সাথে মেলে বা আপনি করতে চান এমন কাজেরও সন্ধান পেয়ে যাবেন।
মনে করার কারণ নেই মাত্র ৫ টা পয়েন্ট অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললেই সব সমাধান। আসলে প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা, তার সমস্যা ও সমাধানও আলাদা হবে। তবে চোখ কান খোলা রেখে কমন সেন্স ব্যবহার করলে অনেক আরামে চলা যায়। আর কোন কিছু নিয়েই দুইটা জিনিস না হওয়া ভাল
- অতি সিরিয়াস (আমাকে পৃথিবীর সেরা হতেই হবে!!!)
- অতি সন্তুষ্ট
পরেরটা আসলে বেশি ভয়ানক। অনেক আঁকিয়েকে আমি আশেপাশেই দেখেছি নিজের কাজ নিয়ে অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে দিন দিন কাজ আরো বাজে হয়ে যাচ্ছে, যেটা প্রাইয় অসম্ভব একটা ব্যাপার, নিজে এঁকে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলে আপনি শেষ। দিন শেষে নিজের কাজের সবচেয়ে বড় সমালোচক হতে হবে আপনার নিজেকেই।
ভাইয়া মূল্যবান টিপসের জন্যে অনেক ধন্যবাদ। কোন ক্ওলাইন্য়েটের সাথে মিটিঙয়ে ওয়েবসাইট, ট্যাব আর কার্ড এই তিনটে ব্যাপারের প্রয়োজনীয়তা আমার কাছেও জরুরি বোধ হচ্ছিলো। তাই বর্তমানে এগুলো সবই ম্যানেজ করে নিয়েছি টুকটাক। এরকম টিপস,উপদেশ আরো চাই ভাই। :)
ReplyDelete*ক্লাইন্টের
ReplyDelete:D
Deleteবস্তুনিষ্ঠ লেখাটার জন্য ধন্যবাদ!
ReplyDelete:D
Deleteভাইয়ার কাজ থেকে মাঝে মাঝে এই ধরনের মূল্যবান টিপস আশা করি । অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভাল থাকবেন। হ্যাপি কার্টুন।
ReplyDeleteওয়েবসাইটটা না করলে আর হচ্ছে না। :P
ReplyDeleteওয়ার্ডপ্রেস দিয়ে নিজেই বানায়ে নাও।
Deleteব্লগটা পড়ে খুবই ভালো লাগলো ।
ReplyDeleteআর একটা মজার ব্যাপার,
আমি আগে থেকে আপনাকেই চিত্রশিল্পী-গুরু হিসেবে ছবি এঁকে যাচ্ছি।
একাডেমীক ভাবে কখনোই আমার ছবি আঁকা শেখা হয়নি।
বিভিন্ন ছবি আঁকার প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহনের জন্য হাতে ছবি পেনসিল নিই, তখন ছিলাম ষষ্ঠ শ্রেণিতে।
আর এখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, কোনো দিন ছবি না এঁকে থাকতে পারি না।
ফটোশপের কাজ আগে থেকেই জানা ছিল,হঠাৎ ইউটিউবে আপনার ইলাস্ট্রাশনের ভিডিও দেখে ইলাস্ট্রাশন শিখেছিলাম ফিন্যানশিয়াল কারনে Graphic Tablet কেনা হয় নাই। তাই কলম দিয়ে এঁকে মাউস দিয়ে কাজ করি।
শুনে দারুণ লাগলো। মাউসও দরকার নেই। খালি কলম পেন্সিলে আঁকাই ভালো। ডিজিটালি আঁকতেই হবে এমন কোন কথা নেই।
DeleteVery much inspiring! পড়ে খুব ভাল লাগলো ভাইয়া।
ReplyDelete