গত শুক্রবার আমাদের (প্রায়) নিয়মিত আঁকিবুকির সেশন আঁকান্তিসের স্কেচবুকিং হল আহসান মঞ্জিল এ। এই দালানটা ঢাকার জন্যে এবং অতি অবশ্যই বাংলাদেশের এই অঞ্চলের জন্যে অনেক কারণে ঐতিহাসিক। বেশ কিছু প্রিয় অপ্রিয় ঘটনার জন্ম এই বাড়িতে। নওয়াব খাজা আব্দুল গণি শোনা যায় কোন এক পর্তুগীজ ব্যবসায়ী সহদর কোজা জোহানেস ব্রাদার্স এর থেকে এই দালান কেনেন। কোজা থেকে পরে খাজা। খাজা বংশের লবণের কারবার ছিল বৃটিশদের সাথে। ভুল না করে থাকলে এই লবণ বৃটিশরা নিয়ে আসতো। এদিক থেকে বিপুল পরিমাণ কাপড় চোপড় এর কাঁচামাল জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হত ইংল্যান্ড এ আর সেখান থেকে খালি জাহাজ না এনে লবণ বোঝাই করে ভারতবর্ষে ফেরত আসতো তারা। সেই লবণ কিনতে বাধ্য হত ভারতবাসী। অনেকটা কইয়ের তেলে কই ভেজে তারপরে আবার কই মাছকেই খাওয়ানো। যাই হোক এই খাজা বংশের সাথে সেই লবণ কেলেংকারীর দায় পুরোটা চাপানো অনুচিত। তবে সিপাহী বিদ্রোহের পরে পরে যখন বৃটিশদের হাতে সিপাহীদের স্বাধীনতা আন্দোলন কঠোরভাবে দমন হল, বাহাদুর শা' পার্কে (এখনকার ভিক্টোরিয়া পার্ক, তৎকালীন আন্টাঘর বা আণ্ডাঘর ময়দান) দিনের পর দিন বিপ্লবী সিপাহীদের লাশ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হল। শোনা যায় তখন আহসান মঞ্জিল এ এই উপলক্ষ্যে তৎকালীন নবাব ভোজ ও বলড্যান্স এর আয়োজন করেছিলেন। সত্য মিথ্যা ঘাঁটতে আবার কিছু পড়াশোনা জরুরী। যাই হোক। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পরেই আমার ঢাকা নিয়ে পড়াশোনার একটা নেশা পেয়ে বসে। তখন বেশ কিছু দারুণ বই পড়েছি এই নবাব পরিবার নিয়ে। এতক্ষণ এত এত বাজে কথা তাদের নিয়ে বলা হল এবারে কিছু ভাল কথা বলা দরকার। ঢাকায় প্রথম নগর সুবিধা চালু করেন এই নবাব পরিবার, নামে কাগুজে নবাব হলেও তারা আসলেই নিজেদের নগরপিতা মনে করতেন। তখনকার আমলে লক্ষাধিক টাকা খরচ করে সবার জন্যে সুপেয় পানির পাইপ্লাইন বসান তাঁরা, প্রথম বৈদ্যুতিক লাইট এরও প্রচলন এদের হাত ধরেই। অন্যদিকে আপাতঃ আইরনিকভাবে হলেও এদিকের, মানে পরবর্তীতে যা পুর্ব পাকিস্তান তার ভিত ও এরাই গড়েন। বঙ্গভঙ্গ এর প্রবল সমর্থক নবাব আহসানউল্লাহর হাতেই বলা চলে পরবর্তী ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্তন, এখনকার বুয়েটের আহসানউল্লা হলটা আসলে সে সময়ের প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (নিশ্চিত হতে পারছি না, কেউ আসলটা জানলে জানাবেন)। কংগ্রেসের মধ্যে সাম্প্রদায়িক আধিপত্যের বিষ যখন অবধারিতভাবেই একটা মুসলিম দল তৈরীর প্রেক্ষাপট তৈরী করতে যাচ্ছে তখন এই আহসান মঞ্জিলেই গঠিত হয় মুসলিম লীগ। সেই কক্ষটার সামনে এখনো লেখা আছে সেই ইতিহাস।
সেই সময় টুকটাক পড়ার ফাঁকে নবাব আহসানউল্লাহর ডায়েরির একটা পাতা পড়েছিলাম লেখা ছিল (কোট করছি না) আমার সামনে ভোগের ও ত্যাগের দুটো রাস্তাই খোলা ছিল, আমি ত্যাগের রাস্তাই বেছে নিলাম।
নবাব পরিবারের ত্যাগ আসলে আমাদের চোখে কতটুকু ত্যাগ সেটা তর্ক সাপেক্ষ। আর ধর্মভিত্তিক একটা দল তৈরী এক সময় অসাধারণ আইডিয়া মনে হলেও বা সে সময় সেটা অপরিহার্য মনে হলেও পরের অভিজ্ঞতা কিন্তু আমাদের সুখকর হয়নি- বরং তার যের বয়ে বেড়াচ্ছি এখনো। যাই হোক েসব ইতিহাসফাঁস বাদ দিলেও শুধু সে সময়ের এই দারুণ ঘটনাবহুল বাড়িটা আমি যতবার দেখি ভাল লাগে। মনে হয় একটা টাইম র্যাপ এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সেদিনকার কিছু কুইক স্কেচ (পরে ডিজিটালি টুকটাক রঙ চড়ানো হয়েছে) দিয়ে দিলাম।
কেউ ঢাকা নিয়ে পড়তে চাইলে আমি একটা বইয়ের নাম আগে বলব- কিংবদন্তীর ঢাকা- নাজির হোসেন এর লেখা। আমি বেশ কয়েকবার পড়েছি বইটা।