আমি এনিমেশনের লোক না, তবে ফ্ল্যাশ বেইজড টুডি এনিমেশনের ওপরে একটা তিন মাসের কোর্স করা আছে। সেই কোর্স শেষে আমার উপলব্ধি ছিল - এনিমেশন আমার কাজ না (আমি খালি ইউনিসেফ এর মীনা কার্টুন এপিসোডের একটা গল্পের মূল গল্পকার আর সেই সাথে সেটার ক্যারক্টার ডিজাইনার হিসেবে কাজ করার একটা সুযোগ পেয়েছি)। ওই পরিমান রবার্ট ব্রুসের ধৈর্য নিয়ে আমি জন্মাইনি। কোর্সের পর এনিমেটরদের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো।
যাই হোক, গত ৯ নভেম্বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম (প্রধান অতিথি হাসানুল হক ইনু'র মজা করে বলা ভাষায়- ফিলিম) সোসাইটির আয়োজিত এনিমেশন ফিল্ম প্রদর্শনী (মূলতঃ বিদেশী) সমাপনী অনুষ্ঠানে রীতিমত আলোচক হিসেবে ডাক পেলাম, সেটা ছিল দারুণ একটা অভিজ্ঞতা। কে নেই সেখানে? বস আহসান হাবীব, সব্যসাচী মিস্ত্রী, নোটন ভাই, ড্রিমার ডঙ্কি'র রানা ভাই, জুবায়ের কেওলিন, চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান (আমার সিট তাঁর পাশে পড়েছিল, একেবারেই সহজ স্বাভাবিক মানুষ), সালজার, শামীম, তানবিন ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। সভার সবেচেয়ে বড় আকর্ষণ সভাপতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। আমি মোটামুটি ইনভিজিবল হবার চেষ্টারত, এই লোক যদি জানতে পারে তাঁর কী কী কার্টুন আমি এঁকেছি তাহলে বাংলাদেশের এনিমেশন শিল্পের এখানেই একটা সমাপ্তি ঘটে যাবার সম্ভাবনা আছে। যাই হোক, প্রথমে আহসান ভাই আর রানা ভাই কথা বললেন, এর পরে আয়োজকদের পর্ব, আর তার পরেই তথ্যমন্ত্রী, এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি বেশ ভাল বললেন। এনিমেশন নিয়ে উনি রীতিমত হোমওয়ার্ক করে এসেছেন বোঝা গেলো। আর তাঁর ছেলে নাকি নিজেই এনিমেটর, ত্রাতুলের জগত আসলে তাঁর ছেলে আর তাঁর স্ত্রী মিলে নিজেদের হাউজ থেকে করেছেন। শুনে বেশ ভাল লাগলো। আর উনি মোটামুটি ভালই খোঁজ রাখেন এইসব নিয়ে অন্তত বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীর সাপেক্ষে সেটা অনেক। কিছুদিন আগে যে বাংলাদেশের নাফিস বিন জাফর পাইরেটস অব দ্যা ক্যেরিবিয়ানের একটা ইফেক্ট এ কাজ করার জন্যে টেকনিক্যাল ক্যাটেগরিতে অস্কার পেয়েছে সেটা উনি নাকি জেনে বাংলাদেশে তাঁকে একটা সম্বর্ধনা দেবার চেষ্টা করেছিলেন, এখানের 'কমিটি' নাকি বলছে 'বয়স কম, বাদ দ্যান'।
আমার ইচ্ছা ছিল মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে আরো কিছু কথা বলার কিন্তু টাইমিং উল্টাপাল্টা হওয়াতে সেটা আর হয়নি। উনি চলে যাবার পর শুরু হল মুক্ত আলচনা, আলোচনার প্রথম পর্বেই বিষয়বস্তু ছিল আমার এনগেজমেন্ট উইথ মিতু (ভেবেছিলাম বিয়ে হবার আগে আগে বা কিছু একটা ঘটার পরে পরে আমি হঠাত করে স্মার্ট হয়ে যাব আর সেসব নিয়ে লিখব, কিন্তু আমি আরো ক্ষ্যাত হয়ে গেছি, গত ৭ নভেম্বার কার্টুনিস্ট মিতুর সাথে আমার এনগেজমেন্ট হয় তারপর থেকে আমি কেমন জানি ভ্যাব্দা মেরে আছি, ব্যাপারটা হজম হয়নি এখনো- ফিলিং সাররিয়াল)। মুক্ত আলোচনায় অনেকেই অনেকের ক্ষোভ হতাশা ইত্যাদি বলা শুরু করে, আমি অভ্যাস মত পজিটিভ কিছুকথা বলার চেষ্টা করি, আর শেষে আমার নিজের থিঙ্কিং টা শেয়ার করি।
আমার মতে বাংলাদেশের এনিমেশন ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াতে ব্যর্থ হবার কারণ বাজে প্ল্যানিং। সব এনিমেশন হাউজ কাজ শুরু করে আউটসোর্স করার ভাবনা থেকে, ফলে লোকাল মারকেট দাঁড়ায় নি, তাঁদের দাবি লোকাল মার্কেট এ টাকা নাই। কথাটা সত্যি, কিন্তু আমরা কার্টুনিস্টরা কি একই পরিস্থিতির মধ্যে দিইয়ে যাইনি? আগে কার্টুন এঁকে কার্টুন প্রতি বিল পেতাম ২০০ টাকা যেটা আমাদের যাতায়াত ভাড়ার চেয়েও কম ছিলো। এখন একটা কার্টুন মিনিমাম ৩ হাজার টাকা করে করছি। আর সেই সাথে আউটসোর্সিং ও চালিয়ে যাচ্ছি। আমি যদি এখন দেশে টাকা নাই বলে খালি 'ওডেস্ক' 'ই-ল্যান্স' ইত্যাদী সাইটেই কাজ করতাম তবে ১০ বছর পরেও বাংলাদেশের কার্টুনে আমার কোন অবদান থাকতো না, হ্যাঁ লোকাল মার্কেট অনেক কম রেট বলবে। কিন্তু সেটা তো বাড়াতে হবে, প্রয়োজনে কস্ট ইফেকটিভ ডিজাইন করতে হবে। একটা ছোট কোর্স করে আমি বুঝেছি সেটা অনেক সহজ কাজ। ফ্ল্যশ বেইজড টুডি অনেক সহজে নামানো যায়। দেশী রেট এর মধ্যেই সেটা সম্ভব।
এখন আসি এনিমেটর বা ফিল্ম নির্মাতারা যেই দুষ্ট চক্রে পড়েন বলে আমি মনে করি। কেউ যেন মনে না করেন আমি বিজ্ঞাপন বানানোর বিপক্ষে। অবশ্যই কাউকে না কাউকে বিজ্ঞাপন বানাতে হবে। কিন্তু যিনি ক্রিয়েটিভ কাজ করতে চান আমার মনে হয় তার একটা নৈতিক জায়গা থাকা উচিৎ- বিজ্ঞাপন বলতে আমাদের দেশে এখনো আরেকজনের পণ্য মিথ্যা বলে মানুষকে বোকা বানিয়ে বেঁচে দেয়াকেই বোঝায়। টাকা রোজগারের জন্যে অনেকেই এটা করতে বাধ্য হন (স্বয়ং সত্যজিত বা ক্যালভিন এন্ড হবস এর আঁকিয়ে বিল ওয়াটারসন বিজ্ঞাপন সংস্থাতে প্রথমে কাজ করতেন, তবে ঠিকই একটা সময় অর্থনৈতিক ঝুঁকি থাকার পরেও সেটা ছেড়ে 'নিজের কাজ' শুরু করেন)। বিজ্ঞাপন বানালেই কেউ খারাপ হয়ে যাবেন তা না। তবে যদি কারো কোন কিছু নিয়ে- এনিমেশন, ফিল্ম, ডকুমেন্টারি নিয়ে কোন ড্রিম প্রজেক্ট থাকে তবে এই ফাঁদটা এড়াতেই হবে। টাকার ফাঁদ সবচেয়ে খারাপ ফাঁদ।
মূল প্রসংগ থেকে সরে না যাই। এনিমেশনে আমাদের যেটা হয়েছে বেশ কিছু বড় কম্পানী এই সেক্টরে বিনিয়োগ করেছে, কিন্তু তারা অধিক মুনাফার জন্যে স্পন্সর্ড প্রজেক্ট বা বিদেশী প্রজেক্ট ছাড়া আর কিছু করেনি, ফলে আমাদের লোকাল মার্কেট ডেভেলপ করে নাই। তাই এত বছর পরে যখন একে একে বাইরের অর্ডার বন্ধ হয়ে গেলো আর স্পন্সরদের শখের বাজেট গেলো শেষ হয়ে, তখন হুট হাট করে প্রায় সবগুলি এনিমেশন ফার্ম বন্ধ হয়ে গেলো। এনিমেটররা বেকার হয়ে পড়তে লাগলো। কিন্তু এদ্দিনে যদি লোকাল মার্কেটের জন্যে একটা কাস্টমাইজড ওয়ার্কফ্লো বানানো যেত তবে অন্তত নিজে ফৃল্যান্সিং করে হলেও পেট চালানো যেত- আমরাও পেতাম আমাদের দেশি কার্টুন। ভারতের ছোটা ভীম বা মোটু পাতলুর চেয়ে আমাদের কাজ কিন্তু খারাপ না, অনেক ক্ষেত্রে আমরা অনেক এগিয়ে। তারপরেও প্ল্যানের অদূরদর্শিতার জন্যে এই অবস্থা।
যাই হোক, দেখা যাচ্ছে এনিমেটররা নিজেরাই এই সমস্যা অনেকটা আঁচ করতে পেরেছেন। তারা অচিরেই একটি এসোসিয়েশন গড়তে যাচ্ছেন। কিভাবে কিভাবে আমিও তাঁদের সাথে আছি। আমি আমার সর্বোচ্চ সাহায্য তাদের করব - নিজের বাসায় ফিরে একদিন নিজের দেশের তৈরী কার্টুন না দেখে আমি মরতে চাচ্ছি না।
পুনশচঃ যারা আমার ইনফোগ্রাফিক টাইপ ওপরের কার্টুনটা দেখে মনে মনে ভাবছেন সবই তো বুঝলাম, কিন্তু ডৃম প্রজেক্ট এর টাকা কোত্থেকে আসবে? তাদের জন্যে বলি- টাকা দেবে ভুতে। বিশ্বাস না হলেযেই দুজনের কথা ব্রাকেটে বলেছিলাম - সত্যজিত রায়, আর বিল ওয়াটারসন- তাদের জীবনী পড়েন তারা রীতিমত ধার দেনা করে তাদের প্রজেক্ট করেছেন। ওই পরিমাণ ডেডিকেশন আর সাহস না থাকলে অবশ্য বিজ্ঞাপনের 'শুয়ে থাকুন' লাইনটাই ভাল- ছেলেমেয়ের চিকেন ব্রোস্ট খাওয়া আর ইংলিশ মিডিয়াম পড়া নিয়ে অন্তত চিন্তা থাকবে না আর।