আমি থাকি ঢাকার শহরতলী
মতন একটা জায়গায়। (জায়গাটির প্রমিত নাম ‘রূপনগর’ কথ্য নাম ‘বাড্ডা-নামাপাড়া’)।
এখানে আমি আছি আজ ১৭ বছর। অর্থাৎ নিজেকে এখানের স্থানীয় বলে দাবী করলে তার
বিরোধিতা করবার খুব বেশী লোক পাওয়া যাবে না। এতদিন এখানে থাকার কারণে এলাকায় অনেকের
সাথে বেশ ভাল সম্পর্ক হয়ে গেছে। গলি ধরে প্রতিদিন যখন বের হই নিদেনপক্ষে
গন্ডাচারেক মানুষের সাথে কুশল বিনিময় হয়। আর এলাকাটা এখনো সেই ‘মহল্লা’ ধরনের।
মানে কি না ‘আমগো মহল্লা’ ‘ওই পাড়াত্তে পোলাপান আইসিল’ ইত্যাদি এখনো বেশ শুনতে
পাওয়া যায়। এই সেদিনও বিলের মধ্যখানে এক বাড়িতে ডাকাত পরেছিলো (আমার ছোটবেলার
বন্ধু মুনিরের বাসায়) শুধু একটা ডাকের অপেক্ষা, পাড়া ভেঙ্গে সবাই লাঠিসোঁটা নিয়ে
উপস্থিত। ডাকাতেরা পালিয়ে রক্ষা পেল কোনমতে। অর্থাৎ আমাদের এখানে এখনো ‘সভ্যতা’
এসে ঢুকতে পারেনি। ছোটবেলা থেকে এই এলাকার প্রায় গোটা পঁচিশেক সমবয়েসী পোলাপান এর
সাথে (সংখ্যাটা আরো বেশী) আমি বড় হয়েছি। সেই দলের কেউ এখন বাস চালায়, কেউ মুদী
দোকানী, কেউ মহাস্থানগড় থেকে তরকারী কারওয়ানবাজার পাঠায়। সে যাই হোক, এত ভুমিকা
দেবার কারণ হল সেই রূপনগরে ইদানীং অনেক কিছুই ঠিক আগের মত মিলছে না। যেমন এখন অনেককেই
চিনি না। খেলার মাঠগুলি ডেভেলপারদের বালুর তোড়ে সাদা হয়ে যাচ্ছে, কয়েক হাজার
গার্মেন্ট কর্মীর চলাফেরায় মেঠো পথ আর অন্যান্য গলি তস্য গলি হয়ে থাকে নরক গুলজার।
আর সবচেয়ে বিরক্তিকর ঘটনার একটা হল হঠাৎ হঠাৎ কোন এক বাড়ির ভেতর থেকে বিকট স্বরে
বেজে ওঠা গান। ইদানীং এত এত ঘরবাড়ি উঠে গেছে যে সেই গান কোথায় বাজছে তা বের করতে
করতে সেটা থেমে যায়। বিশেষ করে কোন পালা পার্বণ হলে তো কথাই নেই। পাল্লা দিয়ে সবাই
বাজিয়ে যায়। সে এক ভয়ানক ব্যাপার। তবে
সেটার সবচেয়ে ভয়ানক দিকটা হল সেই গানের নব্বই ভাগই হিন্দী...। জানি সবাই বলবেন এ
আর নতুন কি? নতুন তখনই যখন সেটা বাজে সব উৎসব ও উপলক্ষ্যে। মানে গত ১৬ই ডিসেম্বর এ
একগাদা ‘পোলাপান’ হিন্দী গান ছেড়ে নাচছে এই দৃশ্য আমাকে আমার রূপনগরে দেখতে হয়েছে।
ঈদ, বিজয় দিবস, বিয়ে, ... আমি আতংকে ছিলাম এবার একুশে ফেব্রুয়ারিতেও এই ব্যাপার
ঘটবে। কপাল ভাল সেটা ঘটেনি। এখন এই গোটা ব্যাপারটাকে আমি কিভাবে দেখছি? মানে আমি
কি এখন ‘এই সময়’ এর দোষারোপ করব? যারা এটা করছিলো তাদের মুন্ডুপাত ঘটাব? নাকি কানে
তুলো গুঁজে কার্টুন এঁকে যাব? আসলে কি করব
সেটা না ভেবে আমি গত ১৬ই ডিসেম্বরেই যেটা করেছি সেটা হল সরাসরি যারা এটা বাজাচ্ছিলো
(১৫-১৮ বছরের কিছু-কানে ইয়ারফোন থুতনীতে দাঁড়ি) তাদের কাছে যাই। তাদেরকে জিজ্ঞেস
করি এটা তারা কেন করছে। তারা যে জবাবটা দেয় সেটার মধ্যে আসলে এই সমস্যার একটা দিক
পরিষ্কার হয়ে যায়। তারা বলে- বাংলা গানের এইরকম সিডি নাই। মানে যা শুনে মজা করে
নাচা যাবে। যেহেতু বিজয় আনন্দের, সেহেতু তারা আনন্দের গান ছেড়ে নাচতে চাচ্ছে। এটার
কি উত্তর দেব বুঝিনি, তবে তাদেরকে বুঝাতে সমর্থ হয়েছিলাম যে অন্য ভাষার গান বাজিয়ে
যাতে না নাচতে হয় সেজন্যেই আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। তাৎক্ষণিকভাবে তারা গান বন্ধ করে
দিলেও আনন্দের মাঝে বাগড়া দেয়ায় নিজেরও খারাপ লাগছিলো। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল ক’দিনের
মাঝেই, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একাধিক বন্ধুর বিয়েতে হিন্দী গানের সাথে গুঁড়ি,
বুড়ী, ধাড়ী সবাই মিলে ভুমিকম্প তুলে নাচানাচি করল। আমি উৎসবে নাচানাচির বিপক্ষে
না, কিন্তু যখন আমার আন্টি গোছের কেউ বা বন্ধুস্থানীয়রা ‘মুন্নী বদনাম হুয়ি’ গানের
সাথে কোমর দোলায় তখন ব্যপারটা পরাবাস্তব মনে হয়। এখন ‘এগুলো খারাপ’ ‘হিন্দী এসে সব
নষ্ট করে দিল’ ‘আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে’ ইত্যাদি সস্তা সংলাপ না ভেঁজে আমরা যদি
সমস্যার গোড়ায় তাকাই তাহলে দেখব সে পাড়ার
চ্যাংড়ার দল যা বলেছিল তা-ই ঠিক। আমাদের ‘জোশিলা’ গানের দুর্ভিক্ষ আছে। জানি বলবার
সাথে সাথেই একগাদা প্রগতিশীল পিউরিটান সচেতক (সচেতন-চেতী-লেখক) একটা লম্বা তালিকা
ফেঁদে বসবেন যে আমাদের কত কত ভাল গান আছে আমরা জানি না-ইত্যাদি। কিন্তু নির্মম
বাস্তবতা হল সে তালিকা যত লম্বাই হোক সেটা আমাদের এই সময়কে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। যে কোন উৎসবে
হিন্দী গান বাজাটা তারই প্রমাণ। অর্থাৎ সচেতনভাবে আমরা অবশ্যই বিজাতীয় সংস্কৃতি বর্জন
করব কিন্তু সেই সাথে এর একটা বিকল্পও আমাদের দিতে হবে। যেমন বিয়ের গান- এই সিরিজে
কি ঝিনচ্যাক বাংলা গান হতে পারে না? হাই-বিট, দ্রুত লয়, আধুনিক সাউন্ড সিস্টেমে? দেশের
সেরা ব্যান্ড দল, সেরা সোলো গায়ক গায়িকারা কি সেটা ভেবেছেন? আমি বিশ্বাস করি সেটা
মন দিয়ে করতে পারলে হিন্দী গান বাজানোর সংখ্যা কমতে বাধ্য। মাঝে কিন্তু অনেক বিয়ে
বাড়িতে হাবিব, মাকসুদ, ন্যান্সি এদের গান আমি নিজে শুনেছি। আমাদের অসাধারণ সব গায়ক
গায়িকারা বসে আছেন, ভেবে দেখুন- শুধু এইসব পালা পার্বণ উপলক্ষ্যে যদি আইয়ুব বাচচু,
যেমস, মাকসুদ, হামিন-শাফিন, সুমন, লিংকন, সুফী, মিরাজ, টুটুল ইত্যাদী তেজী গলার
গায়কেরা নতুন গানের এলবাম করেন? আর সেটার প্রচারণা করেন শুধুমাত্র এইসব বিশেষ দিবস
সামনে রেখেই? আশা করি তখন মুন্নীর সাথে নাচার লোক কমবে। সত্যি বলতে অন্যান্য
ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। ঘরে ঘরে সবাই হিন্দী সিরিয়াল দেখছে। আমাদের জ্ঞানী
গুণীরা দর্শকদের নিম্ন রুচীর কথা বলেই খালাস। কিন্তু তারা কি ‘উচচ রুচীর’ কোন নাটক
তাদের দিচ্ছেন যাতে দর্শক চ্যানেল ঘুরিয়ে দেশে ফিরবে? হালে ‘দোরায়মন’ কার্টুন নিয়ে
কথা উঠছে, সেটার ডাবিং হিন্দীতে হওয়ায় তার প্রভাব আরো ভয়ানক। বাচচারা খেতে বললে
জবাব দিচ্ছে- বাদ মে। কিন্তু এর দায় কি বাচচাটার? মানুষ যেটা সুবিধার যেটা আনন্দের
সেটাই গ্রহণ করে। তার জন্যে তাকে দোষ দেয়া যায় না। কিন্তু সেটাকে একটা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে
রাখা যায়। ‘দোরায়মন’ বা এমন অসাধারণ আরো কিছু কার্টুন কি আমরা কেউ বাংলায় ডাবিং
করার কথা ভেবেছি? যদি না ভেবে থাকি তো এটা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। আমাদের বুঝতে
হবে ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা মানে বছরে একটা দিন খালি পায়ে হাঁটা না। বা ফেইসবুক
স্ট্যাটাসে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো...’ লেখা না। এর মানে আসলেই ভাষার জন্যে
কিছু করা। আমরা যে যেখানে আছি সুযোগ থাকলে এ ধরণের কাজ আমরা শুরু করি।
(আমি এই ভাষা দিবসে কথা দিলাম এই বছর আমি
বাংলাদেশী কমিকস নিয়ে ঝাঁপ দেব, যদিও সেটা শূন্যে ঝাঁপ- তাও বাংলাদেশের শিশুরা যেন
দোরেমন পোকেমন বেন টেনের পাশাপাশি বাংলায় বাংলাদেশী কিছু কার্টুনচরিত্র পায় সে
জন্যে আমি আর কাউকে না পেলেও একাই কাজ করব।)
জানতে পেলাম সরকারও এ ব্যপারে কম করছেন না, হিন্দী সিরিয়াল বা দোরেমন বা
মুন্নীর দাপাদাপির জবাবে সমস্ত মোবাইল সেট এ বাংলা কি-প্যাড বসানো বাধ্যতামূলক করা
হয়েছে- সাধু! মানে কি না ভবিষ্যতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যখন হিন্দীতে এসএমএস
লিখবে তখন বাংলা দেখে দেখে কষ্ট করে টাইপ করতে হবে,
কেমন বোঝো?!
:-D চলেন ক্যারাক্টার ডেভেলপ করি... নিজেদের ও কার্টুন এর। :-)
ReplyDeletemehedi vai, comic er colorist post ti ami ki pete pari?
ReplyDeleteসাব্বাশ!! অনেক ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে...সবচে ভালো লাগলো এই ভেবে যে এই রকম ভাবনা আমার একার না...
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
Deleteঅনুমতি ছাড়াই শেয়ার করলাম....আর আমাদের কাঁচা হাতগুলি আপনার ডাকের অপেক্ষারত.....একাজে যেকোন সময় আমরা হাজির থাকবো....
ReplyDeleteসমস্যা হলো "মুন্নি" যখন অ্যাম্যারিকার স্ট্রিপারদেরও হার মানানো অশ্লীল নৃত্য পরিবেশন করে তখন "মুন্নির বদনাম" হলেও এটাকে পারিবারিক(!) বিনোদন মনে করে সবাই "বদনামের" ভাগিদার হয়. অথচ তুলনামূলক ভাবে বুরখা পরহিত কোন বাংলাদেশী মেয়ে হালকা উত্তেজনা-পূর্ণ গান গাইলেই সে বিশেষ বিশেষ "খেতাব" পেতে থাকে; আর ওই "মুন্নির বদনাম"-এর ভাগিদারিরাই তখন দেশের সংস্কৃতি রক্ষায় সচেতন হয়ে উঠে যাবতীয় "গসিপ" ছড়ায়!
ReplyDeleteনাটক/সিনেমার ব্যাপারে বলব আমাদের শেখার আগ্রহ কম. আমরা নাটক/সিনেমার সেটে বিশেষ ব্যক্তিদের তোশামদিতে যা অর্থ ব্যায় করি তার অর্ধেকও ক্যামেরা এবং অন্য কারিগরী খাতে ব্যবহার করি না. আর গল্পের কথা না হয় না বললাম; দেশে এত চমত্কার লেখক থাকতেও টিভি/সিনেমার পর্দার সেই গতানুগতিক "প্রেম" কথন!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাম্যারিকার কার্টুন কিন্তু তাদের পক্ষে বিশ্বের সবার সমর্থন নিতে একটা বিরাট ভুমিকা রেখেছিল (কলেজে অ্যাম্যারিক্যান হিস্টরি ১০২-এ পড়ছিলাম)! আমরা সবাই অ্যাম্যারিক্যান কার্টুন দেখেই বড় হয়েছি; এখনও কিন্তু সবাই তাই দেখছে. ছোটকালে মানুষ যা দ্বারা প্রেরণা পায় তার একটা লেশ বড় হলেও কিন্তু থেকে যায়.
আপনারা একটু ('একটু' বললে ভুল হবে; বলতে হবে 'অনেক') চেষ্টা করলে কিন্তু ঠিকই বাংলা কার্টুন তৈরী করতে পারবেন. দেশী প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে "ফ্যান্টাসি" টাইপের কার্টুন বানান.... বাংলাদেশে অ্যাম্যারিকার সাথে পাল্লা দেবার মতন অ্যানিমেটেড মুভি যদি তৈরী করার উদ্যোগ নেন তাহলে আমি আমার সাধ্যমত সহায়তা করতে রাজি আছি! উস্তাদ....খালি ওয়াজ দিয়েন!
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য- কমিক্স প্রজেক্টের ধারাবাহিক আপডেট সবাইকে জানানোর আশা রাখি
ReplyDeleteশুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন নিন এরকম সুন্দর আর রসালোভাবে আমাদের কার্টুনের আর ক্যারিকেচারের বিভিন্ন দিক বুঝিয়ে দেবার জন্য। আমি আপনার লেখার একজন নিবিষ্ট পাঠক, তবে মন্তব্য করা হয়ে ওঠেনি কখনো।
ReplyDeleteইন্টারনেটের অলিগলিতে চলতে গিয়ে মাঝে মাঝে এমন ধরনের ভাল লেখার সন্ধান পেয়ে যাই, যেগুলো সবসময় হাতের কাছে রাখতে ইচ্ছা করে। সে চিন্তা থেকেই www.bornelegant.wordpress.com এর উৎপত্তি। আপনার আপত্তি না থাকলে আপনার কয়েকটি লেখা সেখানে প্রকাশ করতে পারি, অবশ্যই লেখার নীচে মূল ব্লগ এবং পোস্টের লিংক দেয়া থাকবে।
ভালো থাকবেন, সামনে আরও দুর্দান্ত কিছু লেখা পাবো, এ কামনা করছি।
ধন্যবাদ।