September 22, 2022

মোংলায় ঝটিকা সফর

ছোটবেলা থেকেই ঝটিকা সফর শব্দটা দারুণ লাগতো। আগে ভাবতাম হুট করে ঝটপট গিয়ে ফিরে আসা। এখন জানি ঝড়ের বেগে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসা। সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধান বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এইরকম ঝটিকা সফর দিয়ে থাকলে। ঘটনাক্রমে গতকাল আমি এরকম একটা ঝটিকা সফরে ঘুরে এলাম মোংলা সমুদ্র বন্দর, কেন? কী কাহিনি?

কাহিনি সেই ঘুরেফিরে এক- কমিক্স! ইংল্যান্ডের কমিক আর্টিস্ট কারি ফ্রান্সমান  এর সাথে বেশ আগে পরিচয় হয়েছিলো, সেও এসেছিলো ঢাকায় আমিও গিয়েছিলাম লন্ডনে, যোগসূত্র সেই কমিক্স ও গ্রাফিক নভেল। এত বছর পরে হঠাত তাঁর মেইল। একটা গ্রাফিক নভেল কাম কমিকস প্রজেক্টে আমি কাজ করব ও কি না। ইউকের PositiveNegatives সংগঠন বাংলাদেশের মোংলার নির্দিষ্ট একটি এলাকার পানি সংকট নিয়ে একটা গবেষণা করছে। সেটার একটা অংশ হবে এনিমেশন কাম কমিক্স। মোট চারটা দেশে এই প্রজেক্ট চলবে, বাংলাদেশে তারা আমাকে চাচ্ছে।

না করার কথাই নেই। বেশ মজা পেলাম স্ক্রিপ্ট দেখে আর ওদের কাজ ও ভালো। তো সেই কাজের যে মূল জায়গা মানে যেখানের সমস্যা সেটা দেখতে চাইলে আর্টিস্ট সেখানে ঘুরে আসতে পারেন তাদের খরচে। এই সুযোগ কে মিস করে? সকালে সায়েদাবাদ জনপথের মোড় থেকে বি.এম লাইনের বাসে সোজা মোংলার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম, উপড়ি দেখা হয়ে গেল বাংলাদেশের অন্যতম দারুণ স্থাপনা পদ্মা সেতু।  প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে বাসে করে যেতে যেতে হঠাত মনে হল হলিউডি কোন সাই-ফাই মুভির মধ্যে ঢুকে গেছি। আর ঠিক ঘণ্টাচারেক পরে যখন বাইরে তাকিয়ে দেখি বাগেরহাট তখন রীতিমত অবিশ্বাস্য ঠেকলো। আসলেই দারুণ ব্যাপার। বরিশালের মানুষ আমার আব্বা বেঁচে থাকলে নিশ্চই এই সেতু উপলক্ষ্যে একবার হলেও সবাই মিলে বরিশাল যেতে চাইতেন। যাই হোক।

মোংলা ব্যাঘ্র দ্বার 

এই টাংকিতে উঠেছিলাম (মাঝামাঝি)

বাঁ থেকে লুৎফর, মেহেদী ও মেহেদী

শুধু মেহেদী

সিগনাল টাওয়ার কলোনির ম্যাপ



মাঝে এই টং এ সবাই মিলে কফি খাওয়া হল।


মোংলায় এর আগে গিয়েছিলাম সেই ২০০৪ এ (যদ্দুর মনে পরে)। একেবারে যা-তা অবস্থা ছিল তখন। এবারে খুবই অন্যরকম সব। পশুর নদী পাড় করে অন্য পাড়ে যেতে মনে হল একটা ছোট খাট সেইন্টমার্টিন আইল্যান্ডে চলে এলাম। ছিমছাম শহর, কংক্রিটের বাঁধাই রাস্তা খান খন্দ নেই বললেই চলে। এখানে ওখানে ছিমছাম পুরোনো নতুন সব দোকান, তেমন একটা ময়লাও নেই। মানে বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক শহরের চাইতে বেশ পরিষ্কার। যেই প্রতিষ্ঠানের সাথে এখানে মূল কাজ (ICCCAD) তাঁদের প্রতিনিধি এখানে লুৎফর আর মেহেদী (হ্যাঁ, আমি জানি)। ঘটনাক্রমে লুৎফর আবার আমার জাহাঙ্গীরনগরের জুনিয়র, তাই জমে যেতে সময় লাগলো না। অনেকটা ট্যুরের মতই ঘুরে বেড়ালাম। মূল কাজ পশুর নদীর কোল ঘেঁষে থাকা পুরোনো একটা স্লাম সিগনাল টাওয়ার কলোনি।  সেই 1962 এর দিকে যেটার বসতি শুরু (এর আগেও হতে পারে, ওখানে গিয়ে এই সালটাই সবচেয়ে



 আগের বলে জানা গেল)। এখানে বছরে ৪ থেকে ৫ মাস পানির কষ্ট। শুষ্ক ঋতুতে পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। আর চারিদিকে সমুদ্র+ লবণাক্ত পশুর নদী। তাই এখানের বাসিন্দাদের খাবার পানির ভয়াবহ সংকট। এই সংকটের তথ্য উপাত্ত মিলিয়ে একটা প্রেজেন্টেশন বানানোর কাজ চলছে যাতে এটার সমাধান করা যায়। সেটার একটা অংশ হল আমার কমিক্স ও এনিমেশন। গিয়ে যেটা লাভ হল প্রথম বুঝলাম ঢাকায় বসে লেখা রিপোর্ট বা স্ক্রিপ্টে তাদের যেমন প্রায় মুমূর্ষু একটা গোষ্ঠী মনে হচ্ছিলো আসলে ব্যাপারটা তেমন না। জায়গাটা বাংলাদেশের অন্যান্য আর দশটা গ্রামের মতই শুধু পার্থক্য হল সেটা একটা খাস জমিতে, ফলে কাগজে কলমে সেটা বেআইনি। আর সে কারণেই লিগ্যাল কোন পানির লাইন সেখানে যাচ্ছে না। সেই ঢাকার সব বস্তির মত একই সমস্যা। অন্যদিকে সেখানের মানুষজন বেশ হাসিখুশী, আর একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, বাচ্চারা বা কিশোর কিশোরীরা বেশ প্রাণবন্ত, তাদের আত্মবিশ্বাস বেশ ভাল। নতুন প্রজন্মের গ্রামের সবাই ও বেশ একটা আত্মসম্মান নিয়ে বেড়ে উঠছে এটা দেখতে ভাল লাগলো।

যাই হোক, আমি কিছু স্কেচ করে নিলাম, খুবই ডকুমেন্টেশন টাইপ। ওখানে কিভাবে মাছ ধরে, নৌকা কেমন, সবাই কী ধরনের কাপড় পরে ইত্যাদি। মাঝে একটা বিরাট পানির রিজারভয়েরেও উঠলাম। হাইট ফোবিয়ার কারণে মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠেছি। আর তখন জানতে পারলাম একাধিক বড় পুকুর কিন্তু এই সমস্যার সমাধানে খোঁড়া হয়েছিলো, কিন্তু সে দুটোর গভীরতা যতটা হবার কথা 'বিশেষ কারণে' সেগুলো অতটা গভীর করা হয়নি। ফলে পানির সমস্যা থেকেই গেছে। কী আর করা, আনো এখন বিলাতি ফান্ড। বাংলাদেশের সমস্যাগুলি এতই গোড়ায় যে বুঝতে খুব বেশি মাথা খাটাতে হয় না। 

কাজ টাজ গুছিয়ে বিকেল সাড়ে চারটার ফিরতি বাস ধরার আগে এ পারে ফিরে সবাই মিলে সাঁটিয়ে মাছ ভাত খেলাম, লুতফর আবার মিতুর জন্যে এক বোতল 'অরিজিনাল' সুন্দরবনের মধুও দিয়ে দিল পর্যটনের হোটেল থেকে কিনে। কথা রইলো আবার কখনো হুট করে চলে আসবো।

ফেরার রাস্তা রিভার্স রিপিট, তবে বাসায় সাড়ে দশটারে মধ্যে এসে ডিনার টিনার করে ফেলতে পেরেছি। জয় পদ্মা সেতু! 

No comments:

Post a Comment

হ্যাংওভার কাটিয়ে

একটা সময় ছিল সব জায়গায় লেখা থাকতো (অবশ্যই এখনো আছে) 'রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ'। এখন অবস্থা উলটো। এখন যেন রাজনীতি ছাড়া অন্য আলাপ জমেই না। ...