দীর্ঘ দশ মাস পর ২০১৮ সালের বিজ্ঞান বিভাগের নবম-দশম শ্রেণির ৫ টা (গণিত, উচ্চতর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান) ও আর্টস ও কমার্স বিভাগের একটা (বিজ্ঞান), মোট ৬ টা বইয়ের কাজ শেষ হল। এই মহা-প্রজেক্টের মূল দায়িত্বে ছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার। আর স্যার যখন বলেন যে এটি তাঁর জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ন প্রজেক্ট তখন প্রজেক্টটার গুরুত্ব কিছুটা বোঝা যাবে আশা করি।
বাংলাদেশের বোর্ডের বইয়ের প্রজেক্ট যে কত বিরাট স্কেলের তা বোঝাতে হলে কয়েকটা পরিসংখ্যান জানা জরুরী। এই বই ছাপা হয় মোট ৩৬ কোটি কপি। শুধু নবম-দশম শ্রেণিতেই মোট শিক্ষার্থী ১৫ লক্ষ! এবং এদের সবার হাতে সব জায়গায় বিনামূল্যে এই বই পৌঁছে যেতে হবে জানুয়ারি মাসের এক তারিখে! এটা প্রায় অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার। আমাদের কারো জানামতে বিনামূল্যে এভাবে এত সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক পৃথিবীর আর কোথাও বিলানো হয় না। সেই পাঠ্যপুস্তকের কাজে এবার ডাক পড়েছে আমাদের!
কারোরই ভুলে যাবার কথা না আমাদের পাঠ্যপুস্তকের ইলাস্ট্রেশন আর কন্টেন্টের মানের কী অবস্থা দাঁড়িয়েছিলো। কিছু বই দেখে আমার মনে হয়েছে এতটা অবহেলা নিয়ে যে ছবি আঁকে সে আর যাই হোক শিল্পী নয়। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে এত অবহেলার প্রভাব কি ভয়ানক সেটা ভাবলে আঁতকে উঠতে হয়। ড্রয়িং বা গ্রাফিকাল প্রেজেন্টেশন বইয়েরই অংশ, এবং অনেক গুরুত্বপূর্ন অংশ। সেটা ভাল হলে শিক্ষার্থীরাও ভাল মত বুঝবে ও শিখবে। স্কুলে আমি নিজে খুবি পঁচা ছাত্র ছিলাম, আমি সব কিছুই অনেক দেরীতে বুঝতাম আর সে জন্যে ক্লাসে একটা হাসাহাসিও হত। আমার তখন বেশ রাগ হত, কারণ আমি জানতাম যে এটা বুঝে ফেলছে তার আই কিউ আমার চেয়ে বেশী না। পরে এইচ এস সি তে ওঠার পর আমি একেবারে নিজে নিজে সব বই বুঝে বুঝে পড়া শুরু করি আর তখন আমি আবিষ্কার করি আমাদের বইয়ে সহজ জিনিস গুলি কী কঠিন করে দেয়া আছে। আমি অসংখ্য ডায়াগ্রাম আর চিত্র নিজে বোঝার জন্যে সহজ করে এঁকে নিতাম। এমনকি স্যারদের জিজ্ঞেসও করতাম যে এটা এভাবে না এঁকে এভাবে আঁকলে কি হয় কি না? উত্তর পেতাম- 'বইয়ে যা আছে তাই কর।' বইয়ের প্রতি এই অন্ধ আনুগত্য আর ভুল থাকলেও সেটা মেনে নেবার প্রবণতা দেখলে খুবই বিরক্ত লাগতো। মনে মনে ভাবতাম কখনো যদি এই কাজটা আমি করতে পারতাম।
আমার জীবনের আরো অনেক ঘটনার মতই এবারেও যেটা মনে মনে ভেবেছি সেটা জুটে গেল! ২০১৭ এর জানুয়ারিতে স্বয়ং মুহম্মদ জাফর ইকবাল ফোন দিয়ে বললেন
- টেক্সট বইয়ের ইলাস্ট্রেশন করতে পারবে? সাথে বুক ডিজাইন?
পারবো না মানে? আবেগাপ্লুত হয়ে কী করব বুঝতে না পেরে দুইদিন ঝিম মেরে থাকলাম। তারপর প্রথম মিটিং এ গিয়ে পরে বিশ্বাস হল কাজটা আসলেই করছি।
|
প্রথম মিটিং জানুয়ারি ২৭, ২০১৭। ইয়াসমীন ম্যাডামের মায়ের বনানীর বাসায় আমরা সবাই। |
|
একই ছবি, খালি আগেরটার ক্যামেরাম্যান হিসেবে থাকা তাম্রলিপির
প্রকাশক রনি ভাই বাদ পড়েছিলেন, উনি এবারে মাঝখানে |
এবং প্রথম মিটিং এ আমরা আবিষ্কার করলাম কাজটা এত সহজ না। কারণ এনসিটিবির কাছে কোন বইয়ের সফট কপি নাই! মানে এতদিন যা যা টাইপ করা হয়েছিল তা আবার টাইপ করতে হবে। এবং সেই সাথে তাদের কোন ইউনিকোড বেইজড ফন্ট ও নাই। তার মানে আমাদের এমনকি ফন্ট ও তৈরি করতে হবে। কিন্তু আমি ভুলে যাচ্ছিলাম এই কাজের মূল মানুষটার নাম জাফর ইকবাল। আমাদের কাছে যা অসম্ভবের কাছাকাছি তাঁর কাছে আসলে সেটা খুবই সহজ, কারণ উনি যদি একবার বলেন তাঁর একটা ফন্ট লাগবে, সেটা বানানোর জন্যে অসংখ্য তরুণ ফন্ট নির্মাতা চলে আসবে। এবং সত্যি সত্যি 'অভ্র' খ্যাত সিয়াম রুপালি ফন্টের সিয়াম চলে এসেছে। প্রথম মিটিং এ ফন্ট নিয়ে এত কথা বলার দুটো কারণ।
১. বইগুলি কাজ শেষে ইন্টারনেটে দিলে সেটা ইউনিকোডে না হলে পড়া যাবে না।
২. এনসিটিবির খুবই অদ্ভুত যুক্তাক্ষর রীতির একটা ফন্ট আছে সেটা আর কোথাও নেই, তার মানে আমাদের ঠিক সেটার কপি একটা ইউনিকোড বানাতে হবে।
সিয়াম অসাধ্য সাধন করলো, সেই অদ্ভূত ফন্টের রেপ্লিকা বানিয়ে ফেললো। আর ওদিকে স্যারের সাথে বুয়েটের স্বনামধন্য কায়কোবাদ স্যার মিলে বইয়ের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্য বই সহজবোধ্য/ সুখপাঠ্য করা, ও নির্ভুল করা। তাই লেখকেরা যে আমূল পালটে ফেলবেন সব বই তা হয়নি। কিন্তু যা হয়েছে আমার মনে হয় না এর আগে এনসিটিবির আন্ডারে অন্য কেউ এইটুকু স্বাধীনতাও পেয়েছে। আমরাও আঁকিয়ে হিসেবে ভাগ্যবান। কার্টুনিস্ট মিতু আগেই পাঠ্যবইয়ের কাজে সিদ্ধহস্ত। বেশ কয়েকটা বইয়ের ইলাস্ট্রেশন সে আগে করেছে, কিন্তু সেগুলি ছিল যাকে বলে অন ডিমান্ড। বলে দেয়া থাকবে কী আঁকতে হবে, আর সেটা এঁকে দিতে হবে। এবারের ব্যাপারটা পুরোই আলাদা। পুরো দায় আমাদের মাথায় আর বই গুলো বিজ্ঞান বিভাগের। মানে কোন তথ্যগত ভুল থাকা আবে না। উদাহরণ দেই, হয়ত একটা ড্রয়িং আছে, একটা বাচ্চা ঘুড়ি উড়াচ্ছে। সে এখন যেইভাবে ইচ্ছা ঘুড়ি উড়াতে পারে, ছাদে-মাঠে-ঘাটে যেখানে ইচ্ছা, ঘুড়িটাও যে কোন রঙ্গে যে কোন ঢঙ্গের হতে পারে। কিন্তু এখানে যেমন আঁকতে হবে কিডনির প্রস্থচ্ছেদ! বোঝো এবার। এবং এই প্রথম আমরা জানতে পারলাম আগের বইয়ে এমনকী আমরাও যা যা পড়ে এসেছি সেগুলিতে বেশ কিছু ভুল আঁকা তো ছিলোই, সাথে ছিলো দুর্বোধ্য এমবিবিএস লেভেলের টেক্সট বই থেকে সরাসরি কপি করা জটিলতম ড্রয়িং, যা ডাক্তার হবেন এমন কেউ ছাড়া কাজে লাগার কোন কারণ নেই। পদার্থবিজ্ঞানের জন্যে আছে স্যার স্বয়ং। এবং তাঁর 'ড্রাফট' করে দেয়া আঁকাগুলি আমাদের ফাইনালের চেয়ে সহজবোধ্য। স্যার তরুণ বয়সে কার্টুন আঁকতেন, এই প্রজেক্টে গিয়ে আবিষ্কার করেছি আঁকাআঁকি নিয়ে তাঁর আইডিয়া খুবই উঁচুমানের, খুবই নিপাট। যাই হোক, আমরা বিপদে পড়লাম জীববিজ্ঞান নিয়ে, গুগল ঘেঁটে আর অন্যান্য টেক্সট বই ঘেঁটে মোটামুটি নামিয়ে দেবার পরে দখা গেল বেশ কিছু ভুল তাও রয়ে গেছে। আমাদের হাতের কাছের ডাক্তার ও পিজি হাসপাতালের শিক্ষক ডা: রোমেন রায়হান- অর্থাৎ কিনা রোমেন ভাই- তাঁর শরণাপন্ন হয়ে বেশ কিছু কনফিউশন কাটলো। ওদিকে কেমিস্ট্রির টেস্টটিউব, পরমাণুর ঘূর্ণন, নল, বিকার ইত্যাদি নির্বিকার চিত্তে এঁকে ফেলছে আসিফ। পদার্থবিজ্ঞানের বোরিং ডায়াগ্রাম ধরিয়ে দিয়েছি কার্টুনিস্ট রোমেলের হাতে। সে আমাকে না করতে পারে না বলে সুযোগ নেয়া। আর এদিকে আমি আর মিতু আমাদের পাশাপাশি চেয়ারে বসে এঁকে চলেছি জীববিজ্ঞান আর বিজ্ঞান বই। সত্যি বলতে আমরা পূর্ণ কাজ করেছি এই দুইটা বইতেই। গণিতের দুই বই কায়কোবাদ স্যার তাঁর টিম নিয়ে করেছেন, সেখানে আমাদের হাত দিতে হয় নি। পদার্থবিজ্ঞানে খালি এঁকেছি, সেটার পেইজ মেকাপও জাফর স্যার নিজে করেছেন। তাঁর যুক্তি ছিল কোথাও কোন লাইন না আঁটলে তিনি ঠাস করে দুই এক লাইন ডিলিট মেরে মিলিয়ে দিতে পারবেন দিতে পারবেন, কারণ সেটা তাঁরই লেখা। আমরা সেটা পারব না। আসলে তিনি আমাদের কাজের প্রেশার কমাতেই এটা বলেছেন সেটা বুঝলেও তাঁর ওপরে আর কথা নেই। দিনের পর দিন এই কাজের ফাঁকে আমি নতুন করে আরেকজনের ভক্ত হয়ে গেছি, তাঁর নাম ড: ইয়াসমীন হক। এমন প্রাণচঞ্চল ভালো মানুষ আমি খুব বেশী দেখিনি।
এই প্রজেক্ট চলাকালীন কতবার ভেবেছি কী কী লিখব প্রজেক্ট শেষে, সত্যি বলতে এখন কেমন খেই হারানো লাগছে। আসলে এত এত ঘটনা এত এত কাজ, কার কথা রেখে কার কথা লিখব। কেমিস্ট্রি বইয়ের অন্যতম লেখক বিদ্যুৎ স্যারের কথা বলব? সেটাই একটা বই হয়ে যাবে। জীববিজ্ঞনের লেখক ড: সৌমিত্রকে নিয়ে বলব? পেইজ মেকাপের জন্যে মাহবুব ভাই কত গুলি ছুটি নষ্ট করে দিনের পর দিন কাজ করেছে তা বলব? আসলে কোনটাই এইটুকু জায়গায় বলা যথেষ্ট হবে না, তাই সেই চেষ্টা বাদ দি'। কাজটা আমরা সময়মত শেষ করতে পেরেছি এটাই বড় কথা। কেমন হয়েছে সেটা শিক্ষার্থীরাই দেখবে, তাদের জন্যে বই সহজবোধ্য হলেই আমরা সার্থক। বই সহজ হলে প্রাইভেট পড়া বা কোচিং যদি কিছুটাও কমে সেটাই প্রাপ্তি। আমাদের মান্ধাতা পদ্ধতির মুখস্থ কেন্দ্রিক পড়াশোনার কালচার যদি কিছুটাও কমে তবেই হল।
এই কাজে আরেকটা উপলব্ধির কথা বলে শেষ করি। জাফর স্যারের আমি অনেক আগে থেকেই ভক্ত। কিন্তু এই কাজে এসে আমি কিছু জিনিস তাঁর থেকে শিখে আরো বড় ভক্ত হয়ে গেছি। তাঁর অসম্ভব মনের জোর, আর কাজের স্পৃহা। এটা এবনরমাল। উনি সকাল ১০ টায় কাজে বসে টানা রাত ১১ টা পর্যন্ত একইভাবে বসে কাজ করেন, আমি আর মিতু একটু পরেই মোচড়ামুচড়ি শুরু করি কিন্তু তিনি একইভাবে বসা। এবং সেটা একদিন না, মাসের পর মাস! এর মাঝে স্যার আর ম্যাডাম দুইজনেরই পালাক্রমে চিকুনগুনিয়ায় ধরলো। এই ভয়ানক অসুখের মধ্যেও তাঁরা কাজ করেছেন। অবিশ্বাস্য মনের জোর আর ডেডিকেশন না হলে এটা সম্ভব না।
যাই হোক, পোস্ট আর লম্বা করা যাচ্ছে না, তার চেয়ে বরং কিছু ছবি দেয়া যাক ধারাবাহিকভাবে।
|
ঢাকা কমিক্সের স্টুডিওতে কাজ চলছে |
|
স্যারের সাথে মিতু |
|
স্যারের সাথে আমি (অনেক কাজ করছি এমন একটা ভাব ধরার চেষ্টা) |
|
স্টুডিও, ডানদিকে মাহবুব চাই, মাঝে আসিফ |
|
অবশেষে কম্পিউটার পৃন্ট করে বইএর ডামি প্রস্তুত। সর্বডানে সময় প্রকাশনীর প্রকাশক ফরিদ ভাই।
ডামি বই বাঁধাই এর গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করে দিয়েছেন। |
|
১২ সেপ্টেম্বর, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে স্যার আমাকে ও মিতুকে বললেন
শিক্ষামন্ত্রীকে বইয়ের সিডি তুলে দিতে। শিক্ষামন্ত্রী শুধু যদি জানতেন
কী পরিমাণ কার্টুন আমরা তাঁকে নিয়ে এঁকেছি! |
|
কাজ শেষে গ্রুপ ছবি। মাহবুব ভাই খালি নাই। ডান থেকে কার্টুনিস্ট রোমেল বড়ুয়া,
কার্টুনিস্ট আসিফ, ইয়াসমীন ম্যাডাম, জাফর স্যার, মিতু, আমি আর সিয়াম |
|
বইগুলির কভার বসিয়ে করা মক-আপ গ্রাফিক্স। |
|
বাঁয়ে আগের ড্রয়িং ডানে আমাদের। |
|
সুন্দর করে দাঁত আঁকার পর স্যার ঘেঁটে দেখলেন কারিকুলামে আছে পরিপাকতন্ত্র, দাঁত তার একটা অংশমাত্র,
কিন্তু বইয়ে আছে অসংখ্য দাঁতের ড্রয়িং আর লেখা, যা না থাকলেও ক্ষতি ছিলো না। |
|
আগের ড্রয়িং এখনকার ড্রয়িং, ব্যপারটা শুধু 'সুন্দর' করা ছিলো না।
আরো যথার্থ ও সহজবোধ্য করাটাই ছিলো চ্যালেঞ্জ। এটা মিতুর আঁকা। |
|
মিতুর আর একটা কাজ। রেফারেন্স হিসেবে যা পাওয়া যায় সেটা আঁকলেই কিন্তু চলছে না,
কারণ সেটায় আবার এতই ডিটেইল থাকে যা আবার এই বইয়ের মূল টেক্সট এ নাই। |
|
আগের ডিএনএ বনাম এখনকার ডিএনএ, এখন বেশী প্রোটিন :P |
|
আগের বইয়ে শুধু তীর চিহ্নের ডায়াগ্রাম ছিলো, এখন কমপ্লিট করে রক্ত সংবহন বোঝানো হল।
এটা একই সাথে একটা পেইজের উদাহরণ।
|
|
ওপরে আগের ড্রয়িং, আর নতুন ড্রয়িং আরো পলিটিক্যালি কারেক্ট করার চেষ্টা |
|
রেশম তৈরির প্রক্রিয়া, আগের ড্রইং ওপরে, আমাদেরটা নীচে |
|
কেমিস্ট্রি বইয়ের আঁকা বাই আসিফ |
|
আসিফের বাত্যাচুল্লী |
|
রোমেল বড়ুয়ার করা পদার্থবিজ্ঞানের ডায়াগ্রাম |
বিরাট প্রজেক্ট শেষ হতেই মাথায় এখন রাজ্যের অন্য প্রজেক্ট এসে ঢুকলো। একগাদা কাজ জমে আছে, বইমেলা এল বলে। আপাতত আবার বিদায়। ব্লগে আরেকটু নিয়মিত লেখার আশা রাখি বাকি বছর।