December 18, 2013

কথোপকথনঃ রাম মোহন

তাঁকে বলা হয় 'ফাদার অফ ইন্ডিয়ান এনিমেশন'। ইন্ডিয়ার এনিমেশন ইন্ডাস্টৃর যাত্রা একরকম তাঁর হাত ধরেই শুরু। আমরা বাংলাদেশে তাঁকে চিনি তাঁর তৈরী করা মীনা চরিত্রটি দিয়ে। দুই বছর এগে ইউনিসেফ এর ডাকে মীনার একটা এনিমেশন প্রজেক্ট এ ডাক পাই, সে সময় শুনেছিলাম আগের বারে নাকি রামমোহন এসেছিলেন, এবারে শরীর খুব একটা ভালো না তাই আসবেন না। বেশ মন খারাপ নিয়ে ওয়ার্কশপে যাবার দ্বিতীয় দিন আবিষ্কার করলাম শেষ মূহুর্তে উনি এসেছেন! রামমোহন! আমার সামনে! ব্যাপারটা কি অসাধারণ সেটা বোঝানো কঠিন। যাই হোক আমি ওয়ার্কশপে এসেছিলাম গল্প লিখিয়ে হিসেবে। সেই গ্রুপে থাকবেন ভারতের আরেক অসাধারণ লেখিকা দীপা ভালসাভার। কিন্তু আমার চোখ তো খালি পাশের রুমে :( পরে অনেক কিরিঞ্ছি করে কার্টুনিস্ট মিতু কে লেখিকা সাজিয়ে এই রুমে বসিয়ে আমি পাশের রুমে রামমোহনের সাথে বসে পরি। সেবারই প্রথম একটা ধারনা পাই যে আমাদের মূল সমস্যাটা কোথায়। কার্টুন লাইনে এরকম পিতৃসুলভ একজন গুরু (আহসান হাবীব ছাড়া) আমাদের নাই। এই শ্রেনীর মানুষগুলির সব থেকে বড় ব্যাপারটা তাঁরা ভাল আর্টিস্ট বা ভালো এনিমেটর সেটা না, বড় ব্যাপার হল তাঁরা অনেক বড় মনের মানুষ। অনেক সহজ ও স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ। ওয়ার্কশপ শেষে তাঁকে একটা ক্যারিকেচার করে দেই ও চান্সে একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে নেই। সেই সাক্ষাকার উন্মাদে ছাপা হওয়া 
তার পরের সংখ্যাতেই। এখানে সেটা আবার তুলে দেই।

মেহেদী হকঃ স্যার, আমরা জানি আপনাকে ভারতের এনিমেশন দুনিয়ার জীবন্ত কিংবদন্তি বলা হয়, এবং তার যতটা না আপনার কারীগরি জ্ঞানের জন্য, তার চেয়ে বেশী আপনার অরিজিন্যালিটি নিয়ে, বলা হয় ইন্ডিয়ান ড্রয়িং এ ভারতীয় ঘরানার জনক আপনি। স্যার আমাদের কি বলবেন কিভাবে আপনার পক্ষে এই দুরূহ ব্যাপার সম্ভব হল?

রামমোহনঃ ওয়েল, এটা আসলে একদিনের ব্যাপার না। আমি এই একই কাজে আছি আজ ৫০ বছরেরও বেশী, হয়ত করতে করতে হয়ে গেছে, আসলে একটানা লেগে থাকার একটা ব্যাপার আছে।

মেহেদী হকঃ না স্যার মূল যে ব্যাপারটা আসলে জানতে চাচ্ছি সেটা হল আমরা এখানে বাংলাদেশে অনেক কার্টুনিস্ট -আর্টিস্ট টানা কাজ করে যাচ্ছি, অনেকেরই ডেডিকেশন বলেন, ট্যালেন্ট বলেন... অভাব নেই, কিন্তু যখনই আমরা নিজস্ব স্টাইল আনতে যাচ্ছি তখনই কেন যেন সেটা আমাদের না হয়ে বিদেশী ওয়েস্টার্ন  ঘরানার মনে হয়। জাপানিজরা যেমন মাঙ্গা[1] তৈরী করেছে, তারতাকোভস্কি করেছেন নিও-রেট্রো, ল্যাটিন আমেরিকানরা এবং পার্কশিয়ানরা করেছেন নিজেদের মত স্টাইল এবং আপনি করেছেন ভারতে সেখানে আমরা সেটা কেন পারি না? আমাদের আসলে কী করা উচিত?

রামমোহনঃ দেখো এটা আমি আমাদের ইনস্টিটিউটের সবাইকেও বলি, সেটা হল দেখা নিজেদের স্টাইল করতে অবশ্যই নিজেদেরকে দেখতে হবে। আশেপাশে তাকাতে হবে। আমরা কেমন জামা পরি, কী খাই, কী পড়ি? আমাদের রঙের প্যাটার্ন ক্যামন ইত্যাদী, এর কোন বিকল্প নেই। পৃথিবীর প্রত্যেকটা জায়গার কালচারাল ডাইভার্সিটি আছে, চেহারার পার্থক্য আছে, জামা কাপড় খাওয়া দাওয়া চাল চলন সবই আলাদা আলাদা। আমরা তো কদিন আগে ভারতের চারটা প্রদেশ নিয়ে একটা প্রমো বানালাম, কেরালা, রাজস্থান, তামিল নাড়ু ইত্যাদি। তো তাতে তো আমরা প্রতিটা রাজ্যের আলাদা আলাদা স্টাইল ডেভেলপ করেছি। যেমন কেরালায় একটা টেরাকোটা স্টাইল আছে ওদের নিজস্ব, আমরা সেই পার্ট টা ই স্টাইলে করেছি, রাজস্থানে আছে মিনিয়েচার স্টাইল আর্ট, তারপর ওদের উজ্জ্বল রঙ ইত্যাদি মিলিয়ে তাদের জন্য আলাদা স্টাইল। আসলে একটু খুঁজলে ব্যপারটা ধরা যায়। আসলে তোমরা যদি তোমাদের লোকজ আর্ট গুলি দেখো... যেমন পটচিত্র তো তোমাদের একেবারে নিজস্ব, বা গ্রামের পটারি ইত্যাদি থেকে মটিফ নিলে কিন্তু একটা স্টাইল দাঁড়া করানো যায়।

মেহেদী হকঃ স্যার আপনারা যখন প্রথম কাজ শুরু করেন তখন কি এভাবে গ্রামাঞ্চল ঘুরে ঘুরে স্টাইল খুঁজতেন?

রামমোহনঃ না না, এমনিতে সবকিছু দেখতাম বটে কিন্তু ঘটা করে আমরা এ কাজটা করতে গ্রামে যেতাম না, আমরা আরো সহজে কাজটা সারতাম, আমরা যেতাম যাদুঘরে। আমাদের বেশ ভালো কিছু মিউজিয়াম আছে। যে কোন কালচার স্টাডি করতে সেখানকার সাহায্য নিলেই অনেকটা কাজ হয়ে যায়।
with legend

রামমোহনের স্বহস্তে আঁকা মীনার শট ডিভিশন ০১

রামমোহনের স্বহস্তে আঁকা মীনার শট ডিভিশন ০২
 (দুইটা পেইজই আমি সযত্নে সরিয়ে নিয়ে এসেছি:)

রামমোহনের সাথে বাঁ থেকে আমি, রামমোহন ও 'লেখিকা' মিতু
 (পেছনে পুলকদা-ignore his expression he is actually a nice guy)

বাঁ থেকে (ভাই আপনার নাম ভুলে গেছি এই লেখাটা দেখলে জানান, স্যরি),
 নাফিস ভাই দ্য বস- অগিলভি তে কাজ করেন আমার দেখা কোন 
এড ফার্মের সবচেয়ে ভদ্র মানুষ

ram-mohan
রামমোহন কে দেয়া আমার ক্যারিকেচার- লাইভ আঁকা


 


ram-mohan-autograph
আমার খাতায় দেয়া রামমোহনের অটোগ্রাফ

মেহেদী হকঃ তার মানে কি বলছেন আমাদের এ জাতীয় ফিল্ড স্টাডি করা দরকার?

রামমোহনঃ অবশ্যই, এর কোন বিকল্প নেই, এখনকার আর্টিস্টরা অনেকটাই কম্পিউটারমুখি হয়ে গেছে, নিজের আশেপাশের দৃশ্য আঁকতে গেলে তারা চারদিকে না তাকিয়ে আগে মনিটরে সেটা খোঁজে, ইন্টারনেট... ওয়েল এটার সাহায্য অবশ্যই নিতে হবে কিন্তু এর ওপর পুরো নির্ভর করলে কখনোই অরিজিন্যালিটি আশা করা যায় না।

মেহেদী হকঃ স্যার আরেকটা ব্যপার, আমাদের এখানে কমিক্স ইন্ডাস্টৃ ডেভলপ করেনি, কিন্তু বেশ কিছু এনিমেশন হাউজ গড়ে উঠেছে, তো আপনি কি মনে করেন নিজস্ব এনিমেশন ইন্ডাস্টৃ গড়বার আগে কমিক্স শিল্প দাঁড়ানো উচিৎ? নাকি দুটো পুরো আলাদা ব্যপার?

রামমোহনঃ দুটো ব্যাপারে যোগাযোগ তো অবশ্যই আছে। বলা ভালো কমিক্স হচ্ছে এনিমেশনের ভিত্তি, কারণ ওখানেই প্রথম গল্প বলার শিল্পটা চর্চ্চা হয়। আর ড্রয়িং বল ক্যারেক্টার নিয়ে চিন্তা ভাবনা বল সেটার প্রথম চর্চাটাও তো ওখানেই হয়। যার কমিক্স ইন্ডাস্টৃ যত সমৃদ্ধ তার এনিমেশন তত ভাল হবে। আর এখন তো অনেকে শুধু গোটা কয়েক সফটওয়ার শিখে নিয়ে ধরে নেয় সে এনিমেটর হয়ে গেছে। একটা অবজেক্ট মনিটরে ডান থেকে বামে সরালেই যে সেটার মানে এনিমেশন না এটা অনেকেই বোঝে না। এই সফটোয়ার শেখার কালচার এক অর্থে ইন্ডাস্টৃ কে নষ্ট করছে। কারণ একজন এনিমেটরের ন্যূনতম কিছু ড্রয়িং সেন্স থাকতে হবে, তার আইডিয়া অন্যদের সাথে এঁকে অন্তত বুঝিয়ে বলবার ক্ষমতা থাকতে হবে। আর তার বদলে লোকজন শুধু একটা সফটোয়ার শিখেই ধরে নিচ্ছে সে এনিমেটর। সফটোয়ার তো আসলে একটা টুল ছাড়া আর কিছু না।

মেহেদী হকঃ স্যার আপনি তো এ নিয়ে একাধিকবার বাংলাদেশে এলেন, তো এখানের কার্টুনিস্ট- এনিমেটরদের নিয়ে আপনার মূল্যায়নটা যদি জানাতেন।

রামমোহনঃ ওয়েল, সত্যি বলতে আমি রীতিমত পুলকিত এই দেশের মেধা দেখে। কারণ কার্টুন নিয়ে আমার জানামতে কোন ইন্সটিটিউট এখানে না থাকলেও আমি অসংখ্য ট্যালেন্ট এখানে দেখতে পাচ্ছি। যেমন এই রুমেই এতোজন ট্যালেন্ট একসাথে আছে যা তারা সত্যি বলতে ভারতে এত সহজে একবারে পাওয়া যাবে না। কিন্তু তোমাদের মূল সমস্যা হল কোন ইন্সটিটিউট ডেভেলপ না করা। তোমরা শিখছো নিজেরা নিজেরা। ট্রায়াল এন এরোর পদ্ধতিতে। এভাবে হয়ত আমরা একজন অপু, একজন সুদি বা একজন মেহেদীকে পাব, কিন্তু এনিমেশন বা কমিক্স ইন্ডাস্টৃ একটা টিম ওয়ার্ক। এ ক্ষেত্রে ইউ নিড লিডার। কেউ একজন থাকতে হবে যে কি না এটাকে একটা মুভমেন্ট হিসেবে এগিয়ে নেবে। তুমি জানো আমরা এই এখনো ভারত সরকারের কাছে ধর্না দিচ্ছি যাতে আমাদের শিশুতোষ চ্যনেলে বাইরের এনিমেশনের পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে  প্রতিদিন তিন ঘন্টা দেশী এনিমেশন দেখায়? এটা একটা পলিসি। এতে করে লোকাল ইন্ডাস্টৃ দাঁড়াবার একটা সুযোগ পাবে।

মেহেদী হকঃ স্যার আমাদের যেই লোকবল বা অন্যান্য অভিজ্ঞতা তাতে বিশ্ববাজারে পাল্লা দেয়ার ব্যাপারে খুব বেশী আশাবাদী হওয়া যায় কি?

রামমোহনঃ দেখো বিশ্ববাজার একটা অন্য ব্যপার, আমরা ভারতে কিন্তু প্রথমে বিশ্ববাজার ভাবিনি। আর কখোনই ভেবো না যে তোমাদের প্রতিযোগিতা ডিজনি বা পিকজারের সাথে। আসলে তোমাদের প্রাইমারি ভিউয়ার বা রিডার হল তোমার দেশের লোক, তোমার ভাষার লোক। আর তোমাদের দেশে তো অসাধারণ একটা গিফট আছে- তোমরা সবাই এক ভাষায় কথা বল! এটা তো ভারতে অকল্পনীয়। তার মানে এক ভাষায় বের করলেই সেটা সবাই বুঝবে। আর একটা ব্যাপার খেয়াল কর, পাঠক বা দর্শক কিন্তু খুব বেশী কোয়ালিটির ড্রয়িং বা এনিমেশনের চমৎকারি আশা  করে না, তারা আসলে খোঁজে গল্প। একটা ভাল গল্প হলে আঁকা যেন তেন বা এনিমেশন দূর্বল হলেও সেটা উৎরে যায়। এটা কিন্তু প্রমাণিত। যেমন ভারতের তুমুল জনপ্রিয় একটা সচিত্র সিরিজ... নাম ছিল... অমর চিত্রকথা, এমন আহামরি আঁকা না, কিন্তু ওই বই ছিলো না ভারতে এমন বাসা মনে হয় কম ছিলো। আসলে আমাদের এই ভূখণ্ডের কালচার কিন্তু গল্প বলিয়ে কালচার। আমাদের দাদু নানু বা কথক ঠাকুর উঠানে বসে গল্প বলে আর সবাই তাকে গোল হয়ে ঘিরে গল্প শোনে। সাথের ড্রয়িংটা আসলে কম্পলিমেন্টারি। খেয়াল করে দেখো এনিমেশনেও কিন্তু এই স্টাইলটা ব্যবহার করা যায়। স্টিল পিকচার এর পেছনে কেউ একজন ‘ভয়েস ওভার’ গল্প বলে যাছে, সাথে খুব এলিমেন্টারি এনিমেশন...

মেহেদী হকঃ কিন্তু স্যার আমাদের এখানে ছোট পর্যায়ে যে কটা উদ্যোগ- এনিমেশন বলুন বা কমিক্স নিয়ে বলুন- নেয়া হয়েছে সেগুলো তো মোটেও ব্যবসা সফল হয় নি, এই টিভি, ইন্টারনেটের যুগে মানুষকে হাতে আঁকা বই পড়ানো তো প্রায় অসম্ভব ব্যপার।

রামমোহনঃ হ্যাঁ এটা একটা সমস্যা বটে, এবং এটা বিশ্বব্যপী সমস্যা। তবে ওই অমর চিত্রকথা সিরিজের কথাই ধর। ভারতের প্রবাসী বাবা- মারা তাদের বাচ্চাদের দেশজ গল্প ও কালচার শেখাতে ওই বই গুলো কিনতো, সত্যি বলতে তারাই ওই সিরিজের প্রাইমারি ক্রেতা। তো হতে পারে তোমরা বংলায় লোকজ গল্পকে ইলাস্ট্রেশন করে বাঙ্গালী প্রবাসী বাবা- মা যারা তাদের বাচ্চাদের জন্য বাংলা বই খুঁজছে তাদের কে টার্গেট গ্রুপ ধরে মাঠে নামলে, ইট কুড বি এন আইডিয়া।

মেহেদী হকঃ স্যার আপনার এই দীর্ঘ সফল ক্যরিয়ারের এই পর্যায়ে এসে আপনার সামনের কোন পরিকল্পনার কথা কি জানতে পারি?

রামমোহনঃ পরিকল্পনা হল টু ডু এনিমেশন (স্মিত হেসে) দিস ইজ মাই ওয়ার্ক।

মেহেদী হকঃ আপনাকে এত সময় ধরে কষ্ট দেবার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি স্যার, বাংলাদেশে স্বাগতম।

রামমোহনঃ থ্যাংক ইউ।




[1] Manga: জাপানী কমিক্স।

7 comments:

  1. অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া । সাক্ষাৎকারটি তুলে দেওয়ার জন্য :)

    ReplyDelete
  2. পড়লাম। ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  3. পড়লাম, এখন আমাদের তো মেহেদী হকরাই ভরসা। মেহনত করতে থাকুন ভাই, শুভকামনা রইল। সাক্ষাৎকারটি ভাল লেগেছে। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  4. বেশ ভালো লেগেছে।কৌতুহলউদ্দীপক এবং উৎসাহ ব্যঞ্জনাময় কথোপকথন।

    ReplyDelete

কার্ফিউ এর দিনগুলিতে কার্টুন

হাতে ধরা কার্ফিউ পাসটার দিকে কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছি। নিজের দেশে এরকম একটা পরিস্থিতি জীবদ্দশায় দেখব তা ভাবিনি কখনো। গাড়ির জানালা দিয়...