মাঝে মাঝেই আমার মাথায় বেশ কিছু সমাজসেবামূলক আইডিয়া চলে আসে, যেমন- কার্টুন এঁকে স্টিকার ছাপিয়ে সরকারী অফিসে সাঁটিয়ে দেব- 'ঘুষ খাই তো ... খাই'
অথবা হর্ণ দূষণ কমাতে স্টিকার বের করে গাড়ির পেছনে পেছনে সেঁটে দেই 'হর্ণেই বংশের পরিচয়'।
শহরের ময়লা নোংরা আবর্জনা কমাতে কিভাবে বাচ্চাদেরকে ময়লা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা উচিত সেটা কমিক্স এঁকে ক্যপাটেন প্ল্যানেটের মতে করে বুঝিয়ে দেই। এসব 'বনের মোষ' প্রজেক্ট মাথায় এলেই সেটা আমি নামিয়ে দেবার চেষ্টা করি, খালি আটকে যাই অত্যন্ত বাস্তব একটা সমস্যায়, সেটা হল- এঁকে না হয় ফেললাম কিন্তু সেটা ছাপানোর/ বাস্তবায়ন করার টাকা? একেবারে মিনিমাম কিছু করলেও সেটা ছাপার জন্যে একটা টাকা দরকার। শিল্পী সম্মানী না হয় বাদই দিলাম, ছাপাখানার টাকাটা তো লাগবে?
আশেপাশের লোকজন জানালো এটাও নাকি কোন সমস্যা না, অসংখ্য মানুষ নাকি টাকা নিয়ে বসেই আছে এইসব দারুণ দারুণ (!) প্রজেক্টে দেবার জন্যে, খালি সুন্দর করে একটা প্রোপোজাল বানালেই হবে, টাকার তাঁদের অভাব নেই, অভাব শুধু ভাল আইডিয়ার। আর কষ্ট করে আইডিয়াটা তাঁদের কাছে পৌঁছে দিলেই হবে। শুনে আমি 'হাউ টু রাইট প্রোপোজাল' ধরনের বেশ কিছু আর্টিক্যাল পড়ে নিয়ে প্রোপোজাল লেখা শুরু করলাম ও সম্ভাব্য স্পন্সরদের কাছে যাওয়া শুরু করলাম। আমার বোধোদয়ের শুরু সেখানেই। আমি এক মাসের মধ্যে বুঝে গেলাম যারা এই কথাটা বলেছে যে সমাজের কল্যাণে ফান্ড দেবার জন্যে অনেকেই টাকার বস্তার মধ্যে এক হাত ঢুকিয়ে বসে আছে তারা মিথ্যা বলেছে বা স্রেফ আমার সাথে মজা করার চেষ্টা করেছে।
সম্ভাব্য স্পন্সরদের সবাই বিভিন্নভাবে আমাকে না করে দিচ্ছে কিছু উদাহরন দেই-
ফান্ড নাই
'ইশ একটু আগে আসবেন না এ বছর ফান্ড নাই, কিন্তু চমৎকার আইডিয়া, অবশ্যই পরের বার সবার আগে আমাদের কাছে আসবেন।'
বলা বাহুল্য যে পরের বছর আগে আগে গেলে তারা এবারে আবার বেশি আগে কেন চলে এলাম সেটা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন।
জানাবো
অসম্ভব ভালো আইডিয়া, আমরা এটা স্যারকে জানাচ্ছি, উনি এখন একটু সুইটজারল্যান্ডে আছেন (যেখানে ইন্টারনেট নাই তাই এখন
ইমেইলে জানা যাচ্ছে না), উনি আসলেই আমরা আপনাকে জানাবো।
অন্য আর কী করার আছে?
আরে এই আইডিয়া তো হবেই, এটা রাখেন, এটা তো একেবারে ছোট বাজেটের কাজ ভাই। আর কী কী করা যায় বলেন? একটা বিগ প্রোপোজাল দেন, বছর ব্যাপি পুরো দেশের জন্যে, আপনি লিখে পাঠান, এই ইমেইলে দিয়েন, আর এখানেও একটা সিসি দিয়েন।
যাই হোক, এই উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। কিন্তু এর থেকে রক্ষার উপায় কী তা বুঝলাম না, ওদিকে আবর জাবর প্রজেক্ট অনেক দেখি ফান্ড টান্ড পেয়ে অস্থির অবস্থা, তাহলে এই রহস্যের সমাধান কী?
সমাধানে এগিয়ে এল আমার এক বন্ধু (তার নাম বলা নিষেধ) ধরা যাক তাঁর নাম 'বাস্তব আলম'। সে খুবই বাস্তববাদী। সে এসেই এই সব শুনে টুনে বলল
- ধূর ব্যাটা হাবা, এইভাবে কেউ প্রোপোজাল বানায়? প্রোপো লিখে শেষে জুড়ে দিবি মাছ ধরা জাল, সেইটা হল আসল প্রোপোজাল।
আমি বললাম- মানে?
-মানে শোন- তুই যা করছিস সেটা হ্ল তোর কী ইচ্ছা সেটা লিখে দিচ্ছিস, সেটায় একজন মানুষ কেন টাকা দেবে?
আমারো তাই মনে হল- তাই তো!
-তোর করতে হবে ওরা কী চায় সেটা।
-আচ্ছা- সেটা কিভাবে?
-মনে কর, কেউ চায় তার বাইক খালি বিক্রি হবে আর বিক্রি হবে, তাহলে তুই বাইকের উপকারিতা নিয়ে একটা কমিক্স করবি। পাতায় পাতায় বাইকের ছড়াছড়ি,
-ইয়ে কিন্তু সমাজের তাতে
-আরে দুত্তোর সমাজ, সমাজ হলে তো টাকা হবে না রে গাধা! শোন- মনে কর হালে কিছু একট ক্রেইজ যাচ্ছে, এই মনে কর গাব গাছা লাগান, মাটি বাঁচান। মানে গাব গাছের উপর মনে কর ইউরোপ থেকে ফান্ড আসছে, ব্যাস, সাথে সাথে নেমে পর গাব গাছের চারার ১০ টি গুণ লিখে প্রোপোজাল লিখতে। স্পন্সর পাক্কা। হঠাত দেখছিস না সবাই ক্লাইমেট নিয়ে খুব চিন্তিত, কথায় কথায় ক্লাইমেট চেইঞ্জ, তার মানে বুঝবি ফান্ড আছে! আবার দেখবি জেন্ডার ইস্যু, মানে ফান্ড এসেছে, দেখবি হার্ড টু রিচ, সাসটেইনিবিলিটি, ইনক্লুসিভ সোসাইটি এইসব কখনো শুনোসই নাই টাইপ সব টার্ম জপা শুরু হচ্ছে আশে পাশে- মানে কী বল?
-ফান্ড!
-ইয়েস! দ্যাটস দ্যা সিক্রেট। প্রোপোজালের মধ্যে তোকে ঢুকায়ে দিতে হবে কে কী চায় সেইটা। তুই কী চাস সেটা বাহ্য।
-তাহলে আমার নিজের কাজ কিভাবে হবে?
-নিজের কাজ করলে শুধু নিজের কাজই হবে, টাকা হবে না। হাবিজাবি বাদ দিয়া তারচেয়ে এইবার তুই একটা প্রোপোজাল লিখে ফেল তো।
-কী নিয়ে?
-ফেমিনিজম, বেশ বড় একটা ফান্ড আসছে।
এই শুনে সব ছেড়েছুড়ে আবার আমার তেজগাঁওয়ের ছোট্ট দশ বাই দশ ফুট স্টুডিওতে গিয়ে ঢুকলাম ও আমার নিজের কমিক্স আঁকত্রে থাকলাম, সমাজসেবার ভূত আপাতত মাথায় নেই।
No comments:
Post a Comment