প্রথম আলোর একটা ভাষা দিবসের আয়োজন আছে- বর্ণমেলা। মূলত: শিশুদের জন্যে এই আয়োজন। আমরা ঢাকা কমিক্স থেকে সেখানে গিয়েছিলাম বাচ্চাদের ছবি/ক্যারিকেচার করতে। আমি, কার্টুনিস্ট প্রসূন, কার্টুনিস্ট রকিব। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রায় ১৫০ ক্যারিকেচার করেছি তিনজন মিলে। ভয়ানক ভীড়, রীতিমত লাইন দিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে তাদের অভিভাবক দাঁড়িয়ে ছিলেন।
বাচ্চাদের আঁকা কিন্তু ভয়ানক কঠিন কাজ। কারন তাদের নাক মুখ এর 'ফর্ম ' ডেভেলপ হয়নি তাই সেগুলি বোঝাও কঠিন। লাইন ড্রয়িং এ একটু এদিক ওদিক হলেই চেহারা পালটে বুড়োটে হয়ে যাবে। প্রথম কলম দিয়ে করতে গিয়ে মাখিয়ে ফেলে পরে একটা 6B পেন্সিল দিয়ে করলাম। সেটা বলার জন্যে এই লেখা না, লিখছি কারণ দুইটা জিনিস আমাদের চোখে লেগেছে কাল।
১. বাচ্চাদের কে তাদের বাবা মা এমনকী কার্টুন আঁকা হবে এমন জায়গাতেও এসে তটস্থ কর দিচ্ছে। 'এভাবে বস'
'হাসো! হাসো!'
'দেখো অন্যেরা কত সুন্দর করে বসেছে'
'নড়ে কেন?'
'অ্যাই লাইন ভাংছো কেন? (এটা অন্যদের বাচ্চাকে বলা) '
মানে সব মিলে এই মজার জিনিসটাকেও আতংকজনক কিছু একটা বানিয়ে ফেললেন তাঁরা দেখতে দেখতে। বাচ্চারা সামনে বসে খুবই নার্ভাস ভাবে তাকিয়ে থাকলো। আমরা টুকটাক কথাবার্তা বলে বলে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। ব্যাপারটা ভালো লাগলো না।
২. আমি ক্যারিকেচার এর সাবজেক্ট এর সাথে কথা বলি। কে কেমন সে কী করে সেটাও জানি। যেমন একজনকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে সারাদিন রোদ এ দৌড়াদৌড়ি করে। জিজ্ঞেস করলাম-
- 'তুমি কি খেল?'
- 'হ্যাঁ (অলরেডি সে একটু সহ্য হল, কারণ তার পছন্দের কিছু নিয়ে কথা বলা হচ্ছে) ক্রিকেট খেলি'
এর থেকে আমি সব শেষে তার হাতে একটা ক্রিকেট ব্যাট ধরিয়ে দিলাম, শেষে লেখা বেস্ট ব্যাটসম্যান অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ২০৩৩!
কে জানে এই আঁকাটা হয়ত তার জন্যে অনেক দারুণ কিছু হয়ে গেল।
আমার সামনে তাই যখন এক কিশোরী বছর ১২'র এসে বসলো। দেখেই মনে হল সে অনেক পড়ে, তবে একটা চাপ এর মধ্যে আছে এমন মনে হল। আই কন্ট্যাক্ট করছে না। ভঙ্গী আড়ষ্ট, পিছনে তার মা দাঁড়ানো। আমি জিজ্ঞেস করলাম-
-'তুমি কমিক্স পড়?'
-'হ্যাঁ পড়ি।' ছোট উত্তর।
-কী পড়?
- টিনটিন
- এস্টেরিক্স পড়ো না?
- পেলে পড়ি।
- গল্পের বই?
- মেয়েটা একটু চুপ করে তারপরে বল্ল-
- সারাদিন স্কুলের পড়াই পড়ি, গল্পের বই কখন পড়ব?
- কেন ছুটির দিনে?
- সেদিন কোচিং থাকে।
শুনে আমি থেমে গেলাম। এর মানে কী? ছুটির দিনেও স্কুলের বাচ্চারা একটা গল্পের বই নিয়ে বসতে পারছে না আমরা এমন কী বিদ্যাদিগগজ প্রজন্ম বানাচ্ছি? আমি আর কিছুই বললাম না, কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল বেশ। আসলে এখনকার প্রজন্ম বই পড়ে না, মাথায় কিছু নেই আমরা যারা বলে দায় সারাচ্ছি, তারাই কি আসলে নতুনদের ঠিকমত বেড়ে উঠতে দিচ্ছি? এই বইমেলায় আমার নিজের একটা স্টল আছে, বাংলা কমিক্স এর। সেখানে বসে কিন্তু কখনো আমার মনে হচ্ছে না বাচ্চারা পড়ে না। আমরা ভীড় সামলাত হিমশিম খাই। এবং পুরোনো পাঠকেরা এসে এই সিরিজের আর কী নতুন বই এসেছে সেটা জানতে চায়। বইমেলার এই সময় ছাড়া তারা কি এই সুযোগটা পাচ্ছে? যদি না পায় সেটা আমাদের সমস্যা। বাবা-মায়ের সমস্যা।
মার্চ মাসে বাচ্চাদের স্কুলে স্কুলে বই পৌঁছে দেবার একটা প্ল্যান মাথায় নিয়ে ঘুরছি। দেখা যাক কী করা যায়।
ক্যারিকেচার এর মডেল ও আমি। |
আপনার ব্লগে সাবস্ক্রাইব করা আছে। সব লেখাই ইমেইলে পাই, পড়ি। বাচ্চাদের বই পড়ার অভ্যাস সত্যিই অনেক কমে গেছে। আমার ছোট একটা বোন আছে (কাজিন), ওকে ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার অভ্যাস করিয়েছিলাম। এখন নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। শুনি সে নাকি এখন মোবাইলে সিরিয়াল দেখে বা গান। বই পড়ার আগ্রহ এখনো আছে, কিন্তু উপায়টা পাচ্ছে না। সেদিন বাসায় এলে গোটা পনেরো তিন গোয়েন্দা ভলিউম পিডিএফ ডাউনলোড করে দিলাম। অন্তত ৪৫টা বইয়ের ব্যবস্থা তো হল। কিন্তু বাহির থেকে আর কত বাচ্চাকে বই দেয়া যায়। বাবা-মা'রা যদি একটু বুঝদার না হয় তাহলে কিন্তু খুব বেশি যাওয়া যায় না।
ReplyDeleteকার্টুনিস্ট রকিবের আইডিয়াকে আপনারা নেক্সট টাইম একটু ইম্প্রোভাইজ করতে পারেন - বাবা-মা'কে দিয়ে প্রমিজ করাবেন যেন সপ্তাহে কমপক্ষে চার-ছয় ঘন্টা হলেও বই পড়তে দেয়।
ভালো থাকবেন :)
আপনার কথার সাথে একমত। আসলে জোর করে তো বই পড়ানো যাবে না, সেটা আরেক অত্যাচার হবে। তবে কেউ যদি পড়তে চায় তবে তাকে সুযোগটা করে দিতে হবে। নতুন প্রজন্মের বই না পড়ার দায় আগের প্রজন্মেরও বটে।
Deleteআপনিও ভালো থাকুন।