এনিমেশন কী সেটা নিয়ে কথা বলতে গেলে সেটা হাস্যকর হয়ে যেতে পারে। গুগলের দুনিয়ায় যখন ঘরে ঘরে টিভি, হাতে হাতে ট্যাব আর সারি সারি এনিমেটেড মুভি, গেমস খেলছে সব 'স্মার্ট' ছেলেবুড়ো আর মেয়েরা তখন হঠাত উড়ে এসে জুরে বসে চশমার ডাঁট ঠিক করতে করতে এনিমেশন কী জিনিস সেটা নিয়ে গুরু গম্ভীর আলোচনা শুরু করতে গেলে কেউ 'খাবে' না। তারপরেও যেহেতু লেখাটি এনিমেশন নিয়ে সেহেতু বলে রাখা যাক যে মানুষের বানানো যে কোন ভিজুয়াল সেট এ (ড্রয়িং ই হতে হবে এমন না) যদি কোন মেশিন (মূলত কম্পিউটার) এর মাধ্যমে গতি যোগ করে তা দিয়ে একটা গল্প বলা হয় তবে সেটা এনিমেশন। আসলে এনিমেশন মানে যেটার মোশন আছে এমন কিছু। আমরা এখানে এনিমেশন বলতে কার্টুন এনিমেশন কেই বোঝাচ্ছি, আর সেই কার্টুন এখন আর টম এন্ড জেরিতে আটকে নেই। সেই গণ্ডি ছাড়িয়ে চলে গেছে আরো অনেক দূর। আজকালকার হলিউডি প্রায় সব মুভিতেই ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট আকারে যা ব্যবহার করা হয় তা কোন না কোন রকম এনিমশনই বটে। এবারে আমরা ব্যাপারটা আরেকটু ডিটেইলে বোঝার চেষ্টা করি-
(না বুঝলেও অবশ্য ক্ষতি নেই।)
আগের কথা
আমরা আজকের যেই এনিমেশন দেখি সেটার উৎপত্তি কিন্তু অনেক আগেই। যেই মূল ব্যকরণটা মেনে এই যাদুকরী জগতটা তৈরী করা হয় সেটা আসলে খুবই সরল। মানুষের চোখ একটা বস্তু তার সামনে থেকে সরিয়ে নেবার পরেও ০.০১ সেকন্ড দেখতে পায়। (অনেকেই হয়ত দর্শনানুভূতির স্থয়িত্বকাল শব্দটা অনেক কষ্টে বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে ক্লাস নাইন টেনে পড়ে থাকবেন। এটা সেই জিনিস।) এই ছোট্ট ব্যকরণ এর ওপরে দাঁড়িয়ে আছে এই যাদুর জগত। একেবারে আদিম এনিমেশনের কথা যদি জানতে চান তবে আমাদের চলে যেতে হবে গুহাচিত্রে। মিশরের প্যাপিরাসে পাওয়া বেশ কিছু হায়ারোগ্লিফিক আসলে আজকালকার এনিমেশন বা কমিক্স এর একেবারে প্রাথমিক রূপ। মানে সেখানে একটা ঘটনা দৃশ্যের পরে দৃশ্য এঁকে যাওয়া হয়েছে। যেমন নিচের ছবিটা মিশরের 'বেনি হাসান' এর এক সমাধিক্ষেত্রের দেয়ালে পাওয়া গেছে, দুইজন লোক কুস্তি লড়ছে। ব্যাস এ-ই। এবং এটা করা হয়েছে ৪০০০ বছর আগে! পর পর দেখে গেলে মনে হবে যেন চোখের সামনে ঘটনাটা সত্যি ঘটছে। তবে এ আর যাই হোক এখানে কোন মেশিনারিজ ব্যবহাার করা হয়নি। স্রেফ কিছু ড্রয়িং।
ছবিঃ ৪০০০ বছর আগের মিশরীয় দেয়ালচিত্র। কুস্তি লড়াই
আবার অন্যদিকে ইরানের 'শাহরে সুখতে' নামের জায়গাতে পাওয়া গেছে এই পাত্রটা। এটাকে বরং আরেক ডিগ্রি ওপরে ধরা যায়, কারণ পাত্রটা যদি চোখের সামনে নিয়ে ঘোরানো হয় তবে দেখা যাবে একটা পাহাড়ি ছাগল লাফ দিয়ে একটা গাছের পাতা থেকে কিছু ছিঁড়ে খাচ্ছে। তার একেকটা বিভিন্ন সময়ের পোজ এখানে পর পর আঁকা আছে। পাত্রটার ড্রয়িংটা খুলে ধরলে কেমন হবে সেটা দেখানো হয়েছে নিচের দ্বিতীয় ছবিতে খোলা রিল এর মত করে। (ঘটনাক্রমে ইরানে গিয়ে এই পাত্রটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার রীতিমত রোমহর্ষ অভিজ্ঞতা।) আর এই জিনিস ৫২০০ বছর আগের বানানো!
ছবিঃ ৫০০০ বছর আগে ইরানের শাহরে সুখতে নামের জায়গায় পাওয়া এনিমেটেড পাত্র’
এ গেলো আগের দিকের কথা তবে আসলে যেটাকে আমরা এখন এনিমেশন বলি- অর্থাৎ মেশিন টেশিন দিয়ে যেটা করা হয় সেটার মূল উৎপত্তি ইউরোপ এ। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির ষোড়শ শতকের একটা এনাটমি স্টাডির একটা স্কেচ থেকে দেখা যায় এ রকম ধাপে ধাপে আঁকা মানুষের শরীরের মুভমেন্ট। যেগুলি পর পর দেখলে মনে হবে অনেকটা এনিমেশনের ফ্রেম। এ ছাড়া ইউরোপে ও আমেরিকায় বিভিন্নভাবে এনিমেশনের প্রাথমিক ফর্মগুলি জন্ম নিচ্ছিলো তখন। যেমন ম্যাজিক ল্যন্ট্রার্ন (১৬৫০)
The magic lantern, থুমাট্রপে (১৮২৪)
Thaumatrope, ফেনাকিস্টোস্কোপ (১৮৩১)
Phenakistoscope, জ্যুওট্রপ (১৮৩৪)
Zoetrope ইত্যাদি নামের বেশ কিছু লাগসই প্রযুক্তি তখন আবিষ্কৃত হচ্ছিলো। ইংরেজি বানানটা এখানে দিয়ে দেয়ার কারণ যাতে করে আপনি চাইলে গুগল এ সার্চ করে আরো ডিটেইল জানতে পারেন। আপাতত জ্যুওট্রপ নামের যন্ত্রটার কথা বলা যাক। সেটা বললেই আসলে মূল ব্যকরণটা বোঝা যাবে। যন্ত্রটা দেখতে এরকম-
ছবিঃ জ্যুওট্রপ, প্রাথমিক এনিমেশন যন্ত্র
একটা গোল সিলিন্ডারে কিছু ছোট ছোট চির কাটা আছে। আর সিলিন্ডার বা পাত্রটার ভেতরের গায়ে সেঁটে দেয়া আছে একটা একটা মানুষের বিভিন্ন সময়ে দৌড়ের ছবি। এবারে কেউ যদি হাতে যন্ত্রটার দ- ধরে সেটা জোরে ঘুরিয়ে দেয় লাটিমের মত আর কোন একটা ফাঁকায় চোখ রাখে তবেই যাদু- দেখা যাবে লোকটা দৌড়াচ্ছে! কারণ একটা ছবি দেখে শেষ করতে না করতেই মানে সেটার রেশ থাকতে থাকতেই (সেই দর্শনানুভূতির স্থায়িত্বকাল ইত্যাদি) পরের ছবিটা চোখের সামনে চলে আসছে । তার ফলে মনে হচ্ছে সব একটানা চলছে আর তাতেই মনে লোকটা দৌড়াচ্ছে। যারা এই ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছেন না তাদেরকে আরো সহজ করে দেয়া যাক। আশা করি অনেকেই ছোটোবেলায় এই খেলাটা খেলেছেন/দেখেছেন। খাঁচার ভেতর পাখি।
ছবিঃ পাখি ও খাঁচার এনিমেশন
একটা শক্ত বোর্ড কাগজের একপাশে একটা পাখি আরেক পাশে একটা খাঁচা আঁকা। দুটোই বরাবর সোজা করে আঁকা। এবারে সেই কাগজের দুই পাশে দুটো ফুটো করে তাতে সূতো বেঁধে পেঁচিয়ে দেয়া হল। তারপর ছাড়তেই সেটা এবারে তীব্র গতিতে এমন ভাবে ঘুরতে থাকবে যেন মনে হবে পাখিটা খাঁচার ভেতরে ঢুকে গেছে। চাইলে এখনই কেউ এটা করে দেখতে পারেন। এমনি আরেকটা মজার এনিমেশন আছে হাতে করার সেটার নাম ফ্লিপ বুক। অনেকে কোন মোটা বইয়ের কোণাতে ছোটো ছোট করে পর পর বিভিন্ন ভঙ্গি এঁকে এটা বানিয়ে থাকেন।
|
ছবিঃ ফ্লিপ বুক |
|
ছবিঃ উন্মাদের ওয়াক সাইকেল |
এত কিছু বলে নেয়ার একটাই কারণ, এনিমেশন কিভাবে কাজ করে সেটা বোঝা। আসলে সফটওয়ার বা কোন টুলস যে যাই ব্যবহার করুন না কেন মূল ব্যাপারটা এই যে একই বস্তুর পর পর কয়েকটা ভঙ্গী যদি দ্রুত পর পর দেখানো যায় তবে সেটাই এনিমেটেদ বলে মনে হয়। এই ব্যকরণটা মাথায় রেখে চাইলে নিজেও একটা নতুন পদ্ধতি বানাতে পারেন- তার আগে আমরা এই মূহুর্তে পৃথিবীতে কী চলছে আর আমরা কী করতে পারি সেটা দেখে আসি।
টু ডি আর থৃডি এনিমেশন
এনিমেশনের একন মোটা দাগে দুইটা ধারা আছে থৃডি আর টু ডি। টুডি এনিমেশন হল যেটাতে ছবিগুলি দ্বিমাত্রিক। আমরা যত আগের যুগের ক্লাসিক এনিমেশন দেখি তার মোটামুটি সবই এই টুডি এনিমেশন। ডিজনি লুনি টিউন্স প্রথমদিকের মাঙ্গা আনিমে সবই তাই। টুডি কিন্তু তুলনামূলক কষ্টসাধ্য এনিমেশন। কারণ এখানে সেই আদিম জ্যুট্রপের মত করে ফ্রেম বাই ফ্রেম হাতে এঁকে এঁকে কাজটা করতে হয়। এবং ক্লাসিক্যাল টুডি এনিমেশন- যাকে সেল এনিমেশন বলা হয়- তাতে প্রতি সেকেন্ডের একটা ভালো মুভমেন্ট এর জন্যে আর্টিস্ট এর আঁকতে হয় প্রায় ২৪ টা ড্রয়িং! সুতরাং বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কতটা ধৈর্য্যের কাজ। তবে এখন বেশ কিছু কম্পিউটার সফটওয়ার এই কষ্ট অনেকটাই লাঘব করে দিয়েছে যেমন এডোব ফ্ল্যাশ বা টুনবুম এবং আরো কিছু ভেক্টর বেইজড সফটওয়ার এ মূল মডেলটা একবার বানালেই অনেকখানি কাজ কমে আসে। অন্যদিকে থৃডি তে কাজ করাটা বেশ মজার। যদি বুদ্ধি করে কিছুটা সহজ মডেল করা যায় আর ভালো কাজ জানা থাকে তবে একবার থৃডি মডেল বানিয়ে নেয়া মানে কোন ক্যারেক্টারের একটা পুতুল বানিয়ে নেবার মতই। তখন তাকে দিয়ে আপনি যা ইচ্ছা তাই করাতে পারবেন। সম্প্রতি এ দেশেও বেশ জনপ্রিয় হওয়া কার্টুন সিরিজ মোটু পাতলু কিন্তু এমনই একটি বেসিক থৃডি এনিমেশন। থৃডি এনিমেশন করারও অনেক সফটওয়ার আছে, সবচেয়ে জনপ্রিয় থৃডি ম্যাক্স আর মায়া। আর থৃডি মডেলিং এর জন্যে হালে জি ব্রাশ, মাডবক্স ইত্যাদি বেশ নাম করেছে। এখানে একটা ভুল ধারনা ভেঙ্গে দেবার সময় এসেছে। আসলে এই সফটওয়ায়র গুলি একেকটা কাজের টুল ছাড়া আর কছুই না। সফটওয়ার আপয়ার এনিমশন কওে দেবে না। গল্পও লিখে দেবে না। তাই সফটওয়ার এ একটা বস্তু নাড়াতে পারলেই আপনি এনিমেটর না। এনিমটর বা এনিমেশন স্টোরি টেলিং করতে হলে সবার আগে আপনাকে সেই হাতে কলমে আদিম পেন্সিল আর কাগজেই ফেরত যেতে হবে। বেসিক ড্রয়িং আর ক্যারেক্টার ডিজাইন যদি আপনি হাতে কলমে করতে না পারেন তবে অরিজিন্যাল কাজ করাটা আসলেই দুষ্কর। এখন কথা হল আপনি সব মেনে নিয়ে আসলেই এনিমশন শিখতে ও করতে চাচ্ছেন তাহলে কী উপায়? আমাদের দেশে এনিমেশন এর বেশ কিছু ফার্ম আছে, যেমন
Dreamer Donkey, Ogniroth চাইলে তাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা যেতে পারে। আর নইলে একেবারে ঘরে বসেও শিখে নিতে পারেন অনলাইন ক্লাস করে। আজকাল ইউটিউবএ যেই পরিমাণ রিসোর্স পাবেন তা দিয়ে ঘওে বসে এনিমশনে ডক্টরেট করে ফেলা যায়। খালি লিখুন
How
To animate/ Learning animation. তবে সে ক্ষেত্রে অনলাইনে এত কিছু পাবেন যে খেই হারিয়ে ফেলতে হবে। তার চেয়ে আরো নির্দিষ্ট করে লেখা ভাল। যেমন যদি টুডি শিখতে চান তবে টুডি এনিমেশন, থৃডি শিখলে থৃডি। এবং কোন সফটয়ার এ শিখবেন সেটাও বলে দিলেন। অন পেমেন্ট এডভান্স কোর্স যেমন আছে তেমনি আছে বেশ কিছু ফৃ টিউটরিয়াল। চাইলে একেবারে বেসিকের জন্যে দেখতে পারেন
Lynda বা
cgmasteracademy.com । সুতরাং আগ্রহীরা আর কোন অজুহাত দিতে পারছেন না। বাংলাদেশেই এখন বিশ্বমানের এনিমেশন করা সম্ভব। ইউনিসেফ এর মীনা সিরিজের শেষ সবগুলি এনিমেশন করা হয়েছে এই দেশেই! তাই যদি আইডিয়া থাকে আর থাকে আগ্রহ তবে এখনই উপযুক্ত সময় এই পেশায় আসার। পেশা হিসেবে এটা কেমন? নির্ভও কওে আপনি কতটা ভাল এ ব্যাপারে। যদি একেবাওে একা একাও ঘওে বসে শেখেন আর টুকটাক কাজ করেন ইল্যান্স বা ওডেস্ক এরম ত আউটসোর্সিন এর তবে এই দেশের আটটা পাঁচটা কেরানী চাকরির যে কোণটার চেয়ে খারাপ ইঙ্কাম আপনার হবে না এটুকু বলা যায়। তবে তার আগে বাড়াতে হবে নিজের দক্ষতা, দৈর্য্য আর কজের প্রতি বিশ্বস্ততা। বিজাতীয় কার্টুনের প্রভাবে আমাদেও পরের প্রজন্ম ভিন্ন সংস্কৃতি মনের মধ্যে গেঁথে বড় হচ্ছে। তার একটা বিকল্প বানানোও একটা বড় দেশপ্রেমমূলক কাজ। সেই মাঠও প্রায় ফাঁকা বললেই চলে। সুতরাং আর দেরী করার কিছু নেই, এই মূহুর্ত থেকে শুরু করে দিন।
কে জানে পৃথিবী হয়ত আপনার অপেক্ষাতেই বসে!