গত
বছর ফেব্রুয়ারিতে কথা দিয়েছিলাম কমিক্স নিয়ে মাঠে নামবো। কথামত কাজ করা হয়েছে, এই ফেব্রুয়ারিতে মোট চারটা বাংলা কমিক্স নেমে গেছে বাজারে। প্রকাশ
করেছে ঢাকা কমিক্স, আর তার প্রকাশক আমি নিজেই! গোটা ঘটনার
এটাই হচ্ছে সবচেয়ে কৌতুকের অংশ। দেশে এত এত প্রকাশক থাকতে আমাকে কেন প্রকাশনায়
নামতে হল তার একটা ব্যাখ্যা দেয়া দরকার। এর পেছনে মোটা দাগে দুইটা কারণ আছে
প্রথম কারণ হল আর কোন প্রকাশনী এই ঝুঁকি নিতে রাজী হয়নি। আশ্চর্য
হলেও সত্য, কমিক্স প্রকাশ কেন হচ্ছে না এই নিয়ে সবসময় আর্টিস্টদের দোষ দেয়া হয়,
কিন্তু আসল কথা হল প্রকাশকেরাই কমিক্স করতে সাহস করেন না। আমি চেনাজানা
প্রায় সব প্রকাশক কে কমিক্স নিয়ে কথাবার্তা বলে দেখেছি, তাদের
কেউ এ ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন নি। মনমরা হয়ে বসে আছি এমন সময় একেবারে অনাকাংক্ষিত
একটা প্রস্তাব এল ‘প্রথমা’ থেকে।
তাঁরা চারটা কমিক্স করতে চান। সিমু ভাইয়ের ডাকে প্রথমার রাশেদ ভাইয়ের সাথে একাধিক
মিটিং সেরে টেকনিক্যাল ডিজাইন সহ গোটা প্রজেক্ট বুঝে চলে এলাম। ডিসেম্বারের মধ্যে চারটা
চার রঙ্গা কমিক্স করে দিলে প্রথমা তা ছাপিয়ে দেবে এই গ্যারান্টি পাবার পরে প্রবল উৎসাহে
কমিক্সের গল্প ও থাম্বনেইলিং শুরু করলাম। ঠিক সেই সময়েই দ্বিতীয় কারণের শুরু হল।
এদ্দিন যাদের উৎসাহ ও ভরসায় এমন বিরাট কিছু করার একটা সাহস
পেয়েছিলাম তারা সময় মত সরে পরলো। ডিসেম্বরের কাছাকাছি এসে একজন আগের থেকে কোন কিছু
জানান না দিয়ে চলে গেলেন বাইরে আরেকজন জানালেন তাঁর ‘ভাল্লাগছে না’। আমার
মাথায় পুরো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কারণ কথা দেয়া হয়ে গেছে। প্রথমা থেকে সবাই বসে আছে
কমিক্স এর পাণ্ডুলিপি পাবার আশায়। এত এত কথা বলে শেষে যদি আমরা বই-ই না দিতে পারি
তবে আর কখনো কমিক্স শব্দটাই উচচারণ করা যাবে না। সেই বজ্রপাতের বেগ দ্বিগুণ হল যখন
প্রথমা থেকে জানানো হল আমাদের ড্রাফটগুলির মধ্যে দুইটাই তাদের পছন্দ না, কারণ কালার নাকি ‘ময়লা’। আর তাদের জন্যে
প্রথমবারে একশন টাইপ সিরিয়াস কমিক্স না করে ছোটদের কিছু
ঝকমকা কমিক্স করাই ভালো। আমার বলার কিছুই ছিলো না। জুনিয়র দুইজনকেই জানিয়ে দেয়া হল
কী হতে যাচ্ছে, সিনিয়ররা আগেই গা ঢাকা দিয়েছেন। মন খারাপ করে
ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যায় বাসে ঝুলতে ঝুলতে মিরপুরের উন্মাদ অফিসে গেলাম। সেখানে বস
দ্যা গ্রেইট আহসান হাবীব মূহুর্তের মধ্যে গোটা ঘটনা শুনে বলে উঠলেন
-ভাল হইছে তো, এইবার তুমি নিজে ছাপায়া ফেল।
-আমি?
-হ্যাঁ, প্রকাশক হয়ে যাও। প্রকাশক হইতে
কিছু লাগে না , তিন হাজার টাকা দিয়া একটা ট্রেড লাইসেন্স
করালেই হয়।
এরপর উনি যা বললেন আমার মনে হয় এটা সবার সাথে শেয়ার করা উচিত,
উনি বললেন-
আসলে একটা নতুন কিছু করা উচিত। আমার কাছে অনেক তরুণ আসে উন্মাদ
নিয়ে একটা কিছু করতে চায়। আমার খুবই হাস্যকর লাগে। উন্মাদ নিয়ে নতুন কিছু করার নাই
তো। এটায় একজন তরুণ এফোর্ট দিয়ে এমন কী করে ফেলবে? তার
চেয়ে তার এই এফোর্ট টা নতুন কিছুতে কেন দেয় না? শুরু কর,
কি আর হবে? বড়জোর ফেইল করবা? আমি আমার লাইফে কত কিছুতে ফেইল করছি। কিন্তু আমাদের সময়ে আমরা উন্মাদ
করছি, সেটায় আমি লেগে ছিলাম। তখন কি কোনভাবে ভাবছি যে এটা
এমন একটা জায়গায় আসবে? আমাকে কেউ চিনবে? এসব ভাবলে আর কাজ করা হত না। নিজের আনন্দে কাজ করে গেছি। লেগে থাকছি।
শুরু কর লেগে থাকো একটা কিছু হবেই। নাও পুরী খাও।
আমি
মিরপুরের খাতা পুরী খেতে খেতে ভাবলাম, হুম তাই করবো যা
আছে কপালে। উত্তেজিত অবস্থায় নিউ এইজ অফিসে এসেই ভাবলাম সবার আগে একটা ওয়েব সাইটের
ডোমেইন কিনে ফেলবো নাকি? (আমি যে কোন প্ল্যান করার সাথে
সাথে সেই নামে একটা ডোমেইন কিনে ফেলি, আমার যুক্তি হল
প্রজেক্টা সাক্সেস হবার পর দেখা যাবে ঐ নামে ডোমেইন নাই তখন দেখা যাবে মাঝখানে
হাইফেন শেষে বিডি ইত্যাদি লিখতে হবে, এতে করে আমার নামে
অসংখ্য ডোমেইন কেনা হয়ে আছে যার কোনটারই অবশ্য তেমন কোন কাজ নেই শুধু বছর বছর তার
পিছনে খালি টাকা দিতে হয়। এই কাজটি আমার চেয়েও প্রবল উৎসাহে
করে আমার প্রোগ্রামার বন্ধু আফতাব। তাকে ফোন করলেই সে সাথে সাথে ডোমেইন কিনে ফেলে।
কিনে আমাকে ফোন দিয়ে উত্তেজিত স্বরে বলে দোস্তো কিইনা ফেলছি! আরো কিছু আছে?) ডোমেইন কেনার পর ট্রেড লাইসেন্স, (ওদিকে
কমিক্সের খবর নাই।) জনে জনে কমিক্সের জন্যে একটা নাম চেয়ে বেড়ালাম, সবাই পরে জানাচ্ছি বলে কেটে পড়ে। শেষে আবারো সেই বস দ্যা গ্রেটের কাছে
গেলাম। তিনি ভ্রু কুঁচকে জানালেন সহজ নাম দাও, ধরো ঢাকা
কমিক্স। তাই সই, পরদিনই সেই নামে ট্রেড লাইসেন্স করা হল,
কাজ শুরু হতেই দেখা গেল অনাকাংক্ষিত সব জায়গা থেকে সাহায্য আসতে
থাকলো। ট্রেড লাইসেন্স করে দিলেন কার্টুনিস্ট আবু ভাই। এই ভদ্রলোকের মত ভালো মানুষ
আরো কিছু দরকার ছিলো আমাদের। ছাপার ব্যাপার বিনা বাক্যে রাজী হয়ে গেলেন কনক ভাই
দ্য গেইট (এই ভদ্রলোক কেন আমাদের যে কোন লস প্রজেক্ট শুনে সাথে সাথে বলেন-নামিয়ে
দিচ্ছি ভেবো না- সে এক রহস্য)। সব
ঠিকাছে কিন্তু কমিক্স? সেটাও ম্যানেজ হয়ে গেল। শামীম আহমেদ
আর আরাফাত করিমের সেই ‘ময়লা’ কালার
এর দুইটা আমার একটা আর কার্টুনিস্ট তন্ময়ের একটা। ঠান্ডা মাথায় একটা ডিজাইন করা
হল। কোন কমিক্স ই ১০০ টাকার বেশী হবে না। চার রঙ্গা ভালো কাগজে এবং তিন ফর্মায়
ছাপা হবে। চার রঙ্গা কারণ বইমেলায় প্রথম রিলিজ হিসেবে সাদা-কালো জমবে না। ভেতরের
কাগজ আর রঙ ভালো হওয়াটা জরুরী। সাইজ হবে স্ট্যান্ডার্ড কমিক্স এর। সব ঠিকঠাক।
হিসেব করে দেখা গেল উন্মাদের স্টলে যদি চারটা কমিক্স একেকটা হাজারখানেক করে রাখা
যায় আর একেকটা শ’পাঁচেক ও চলে তবে পরের কমিক্স শুরু করা
যাবে। সব কিছু আন্ডার কন্ট্রোলে, এক কথায় কোথাও কোন সমস্যা
নেই। পর পর কয়েক রাতে হাসিমুখে ঘুমাতে গেলাম।
জানুয়ারির
১৫ তারিখ মাথায় বাজ পড়লো। এবারে উন্মাদকে স্টল দেয়া হয়নি! ২৭ বছর পর বাংলা একাডেমির
মনে হয়েছে এটাকে স্টল দেয়া ঠিক হচ্ছে না, কারণ উন্মাদ একটা ম্যাগাজিন,
বই না। আমাদের সব পরিকল্পনা মূলতঃ উন্মাদের স্টলকে কেন্দ্র করেই ছিলো
তাই সেটা বাদ পড়ায় একেবারে দিশাহারা বোধ হল। কারণ তাহলে কোথায় রাখা হবে কমিক্স?
আর সে সব জায়গা থেকে আদৌ কত টাকা তোলা যাবে? পরের কমিক্স করাতো আর হবে না...। কমিক্স প্রজেক্ট আবার থমকে গেল। সেদিন আবার
সেই মিরপুর, গিয়ে দেখা গেল বস ভয়ানক মূষড়ে পড়েছেন। (আমি
ইদানীং এইসব নিয়ে মন খারাপ করি না, কারণ আমাদের মত একটা জাতি,
ভারত বিভাগ না হলে যাদের কোন রাজনৈতিক বাউন্ডারি পাবার কথা ছিলো
না,তাদের আবার একটা একাডেমি, আর
তাদের থেকে আমরা আবার শুভবুদ্ধির আশাও করব? উন্মাদ ও
চিল্ড্রেন বুক বা অল্টারনেটিভ বইপত্র যে কাকবন্ধ্যা লিটল ম্যাগ বা বাথরুমের টিস্যু
কোম্পানীর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝার জ্ঞান এই একাডেমির ডিজির হলে সেটাবরং
অস্বাভাবিক হত ) তাঁকে ঠান্ডা মাথায় জানাই যে কমিক্স তাহলে বাদ দিচ্ছি। শুনে তিনি
সাথে সাথে প্রতিবাদ জানালেন। তার বক্তব্য যুক্তিযুক্ত, তাঁর
কথা হল বাংলাদেশের কমিক্স উন্মাদের স্টল পাওয়া না পাওয়ার ওপর নির্ভর করে থাকলে
সেটা নিপাট বোকামী। উন্মাদ না থাকলে কি আমরা কমিক্স করতাম না? সব শুনে টুনে রিচার্জড হয়ে বের হলাম। যা আছে কপালে, একবার যখন কাজে
নেমেছি শেষ না দেখে ছাড়ছি না। এবারে একটা ব্যাপার ভাল যে প্রথম থেকেই কোন টেনশন
নাই, কারণ আমরা জানি যে কোন বিচারেই এটা একটা বিরাট লস প্রজেক্ট হতে যাচ্ছে। উন্মাদ
অফিস থেকে বের হয়ে কঠিন মুখে কার্টুনিস্ট তন্ময় আর আমি দুই কাপ চা খেতে খেতে এই
বিরাট গন্ধমাদনকে হেসে উড়িয়ে দেবার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। দু’জনে হিসাব নিকাশ
করে এও বের করে ফেললাম যে এই গোটা প্রজেক্টের টাকা আমরা সহজেই কিছু এনজিও খ্যাপ
মেরে উঠিয়ে ফেলতে পারবো। যাই হোক, এবারে আবার পূর্ণদ্যমে কাজ শুরু হল (যদিও কোথাও
তাল কেটে গেছে)। বইয়ের জন্যে
ন্যাশনাল আর্কাইভস থেকে খাঁটি ISBN
তুলে আনা হল। কয়েক হাজার পোস্টার ছাপায়ে ঢাকা শহর ছারখার করে ফেলা
যায় কিনা তা ভেবে একটা পোস্টার ডিজাইন করা হল। এবং সেইসাথে খোলা হল একটা ফেইসবুক
পেইজ। এরই মাঝে হটাৎ প্ল্যান এল যে ফেব্রুয়ারিতেই আমরা যদি বাংলা
একাডেমির আশেপাশে কোথাও কমিক্স নিয়ে বসে পড়ি তবে কেমন হয়? ভাবতে ভাবতে মাথায় এল
জায়গাটা হতে পারে পাবলিক লাইব্রেরি। ভাবনার সাথেই সাথেই সর্বসম্মতিতে তা গৃহীত হল। পরদিন সোজা পাবলিক লাইব্রেরি। তাদের সামনের
চত্বরটা এক মাসের জন্যে পেলে এই যাত্রা পার করে দেয়া যাবে। পাবলিক লাইব্রেরিতে
গিয়ে আমার আরেক অভিজ্ঞতা হল। সেখানে সব কিছু ঠিকঠাক মতই চলছিল। এমনকী ফেব্রুয়ারির
সাত তারিখের পর থেকে সেখানে জায়গাও ফাঁকা পাওয়া গেল। নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত কাগজে
দরখাস্তও জমা করে ফেললাম, রীতিমত উত্তেজিত হয়ে যখন ফিরতে যাচ্ছি তখনই এক দপ্তরী
জানালো ‘স্যার’ মানে ডিজি সাহেব ভেতরে আছেন, চাইলে একবারে দেখা করে অনুমতিটা এখনই
নিয়ে নেয়া যায়। শুনে সাথে সাথে স্যার এর সাথে দেখা করতে তাঁর রুমে এলাগেলাম। ঢুকে
ধাক্কা মত খেলাম। বাউল সদৃশ চুলের রক্তচক্ষুওয়ালা এক লোক বসে পান চিবুচ্ছে, এবং
একটু পরে বুঝলাম তিনিই ডিজি। দরখাস্ত এগিয়ে দিতেই বললেন
-
কি ব্যাপার?
-
জ্বি স্যার আমরা একটা কার্টুন ও কমিক্স মেলা করতে চাচ্ছি
-কি?
এইসব কার্টুন ফার্টুন করার সময় নাই আমাদের।
-
স্যার আপনাদের করতে হবে না, আমরাই করবো, মেলাটা জমবে আশা করি।
-
আর জমার দরকার নাই, আমরা অনেক জইমা আছি
-
স্যার উন্মাদ ম্যাগাজিনও থাকবে সাথে
-
‘উন্মাদ?’ আমরা নিজেরাই উন্মাদ হয়া আছি
এরপর
ডিজি পদাধিকারী ভদ্রলোক পানের লালচে ছ্যাপ ছিটাতে ছিটাতে যা যা বললেন তার সারমর্ম
হল, তারা এমনিতেই অনেক ব্যস্ত, লাইব্রেরির জিনিস্পাতি সামাল দিতেই অনেক কষ্ট, সেই
সাথে ওইদিক বাংলা একাডেমির মেলা চলাকালীন এখানে আরেকটা মেলা তারা করতে পারবেন না।
এটাই উনার শেষ কথা। স্টল দেয়া হয়নি বলে মন খারাপ হয়নি, মন খারাপ হয়েছে একটা দেশের
পাবলিক লাইব্রেরির ডিজির কথাবার্তা শুনে। কার্টুন
কমিক্স ইত্যাদিকে একেবারে এক কথায় উড়িয়ে দেয়াটায় খারাপ লেগেছে, মনে হল হয়ত বেশ
গম্ভীর রসকষহীন মানুষ, এ সব ব্যাপার বোঝেন না (কৌতুকের ব্যপার হল বইমেলা চলার সময়
জানতে পেলাম এই ভদ্রলোক শখের ছড়াকার, যে কোন গুরুগম্ভীর সেমিনার বা অনুষ্ঠানে নাকি
তিনি স্বরচিত রসের ছড়া পড়ে অনেকেরই বিরক্তি উৎপাদন করেন-সেলুকাস!)।
পাবলিক
লাইব্রেরি থেকে বের হয়েই সামনে পড়লো ছবির হাট। সাথে সাথে মনে হল পাবলিক লাইব্রেরিতে
না হয়ে ভালই হয়েছে, ছবির হাটে মানুষ আরো বেশী আসবে, বইমেলায় যাবার পথে পড়বে বলে
অনেকেই এখানে ঢুঁ মেরে যাবে। আবার উৎসাহিত হয়ে ছবির হাটের হাঁটুরে কার্টুনিস্ট বিপুল ভাইকে ফোন দিলাম, তিনি
সন্ধ্যায় দেখা করতে বললেন। এবং সন্ধ্যায় ছবির হাট এ গিয়ে জানা গেল সেখানেও
ফাঁকা নেই, প্রথমে চলবে ছবি মেলা, তারপরে বিপুল ভাইদের ঘুড়ি উৎসব। ছবির হাট ফাঁকা
হবে গিয়ে সেই ২০ তারিখ। সান্ত্বনা পেলাম, তাও তো এক সপ্তাহ থাকা
যাবে। বেশ কিছু পোস্টার ব্যানার আর কাট-আউট ক্যারেক্টার বানিয়ে জমিয়ে দেব।
এইসব
ডামামডোলে আমার নিজের কমিক্সের কাজই আটকে আছে, তার সাথে চলছে বইমেলার বেশ কয়েকটা
বইয়ের ইলাস্ট্রেশনের কাজ, ওদিকে প্রেসের কালাম ভাই প্রডাকশনের যেই হিসাব দিয়েছেন
তাতে চারটা বই করে পথে পথে ট্রাফিক সিগন্যালে নিজের কমিক্স ফেরি করা ছাড়া উপায়
দেখছি না। টাকার জোগাড় কোত্থেকে হবে, কমিক্স কখন আঁকবো, আর কখন কোথায় তা বিক্রি
করবো এইসব ভাবতে ভাবতে তব্দা মেরে নিউ এইজ অফিসে বসে থাকি। আমার ডেইলি কাজ
পলিটিক্যাল কার্টুনও আঁকা হচ্ছে না, ওদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিরাট
ক্রান্তিকাল শুরুর আলামত দেখতে পাচ্ছি। যাই হোক, সময়মত বাংলা একাডেমির বইমেলা শুরু
হল, এবারের বইমেলা আহসান ভাইয়ের বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদকে উৎসর্গ করে।
অনেকটা সেই কারণেই আহসান ভাইয়ের প্রাগৈতিহাসিক প্রকাশনা ‘দিনরাত্রি’ কে একটা
নামেমাত্র স্টল দেয়া হয়েছে। সেখানে নিয়ম মেনে আমরা উন্মাদের ‘বই’ রাখতে পারব। আর
ওদিকে সব কমিক্স এর কভার ছাপা হয়ে গেছে। তাতেই যে পরিমাণ টাকা বের হয়ে গেল তারপর
ভেতরের কিছু আর ছাপানো যাবে বলে মনে হল না। কমিক্স আর্টিস্টদের সে কথা বলে
প্রত্যেককে তার কমিক্স এর প্রচ্ছদ একটি করে ধরিয়ে দেয়া হল। বলা হল এই মেলায় এটাই,
বাকিটুকু পরের মেলায়। দেখা গেল সবাই তাতেই খুশী। যাই হোক , শেষ পর্যন্ত প্রেস এ
বিরাট সাইজের এক বাকীর খাতা খুলে একে একে সব কমিক্সই ছাপা শুরু হল। এবং সেই সময় আবিষ্কার হল আমরা প্রকাশনা ইতিহাসের সবচেয়ে কুফা
কম্পানী। ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হল শাহবাগের গণজাগরণ। মেলায় ভোঁ ভোঁ। একটা মাছি
নাই। শাহবাগ হয়ে কেউ এখানে আসছে না। পেশাদার ঘাগু সব প্রকাশক মাথায় হাত দিয়ে বসে
পড়েছেন। তাঁদের চালানই উঠবে না এমন অবস্থা। ওদিকে কমিক্স ছাপায় একের পর এক
টেকনিক্যাল ঝামেলা হতে লাগলো, একটা কভার মাপে উলটাপালটা এসে এক হাজার কপি বাদ হল।
পরের আরেকটা বই (সেটা আমার- নো ওয়ান্ডার) ছাপায় যত রকম ভুল হওয়া সম্ভব তার একটা মডেল বই
হসেবে বের হল। ওদিকে নিজেদের স্টল না থাকায় উন্মাদের কোন সেলই নাই, স্টলটা যেখানে
পড়েছে সেটা এমনই যে, স্টলে যে বসে সে কোন কারণে একবার স্টল থেকে বের হলে নিজেই আর
সেটা খুঁজে পায় না। (এবারে একটা মজার ব্যপার দেখলাম, উন্মাদের বইমেলা স্টলে
প্রতিবছর কিছু অতিথী পাখী আসে, তাদের পরিমাণ এতই বেশী থাকে যে মাঝে মাঝে আহসান ভাই-ই স্টলে ঢুকতে পারেন না। এবারে স্টল
না পাওয়ায় তাদের কারো দেখা মিললো না- আমরা খুশী, ভাবছি পরেরবারেও দিনরাত্রি নামেই
স্টল নেব। )
মেলার
প্রথম দশদিনে দুটো কমিক্স চলে এল,( কার্টুনিস্ট মিতু ওদিকে সমানে পরের দুইটার
প্রুফ দেখে শেষ করে এনেছে- যদিও আঁকাই শেষ হয়নি) আমরা উত্তেজিত, এবং আরো উত্তেজিত
এই কারণে যে অপ্রত্যাশিত সব সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে। কোন স্টলে কিভাবে বই রাখে কিছুই
জানি না, দেখা গেল আমাদের পরিচিত প্রকাশকেরাই যেচে পড়ে কমিক্স নিয়ে রাখতে চাচ্ছে
তাদের স্টলে। প্রগতির আসরার ভাই, বর্ষাদুপুরের বন্ধুস্থানীয় মাশফিক, শুভ্র
প্রকাশের রতন ভাই (বিভিন্ন ফিচকা বুদ্ধি দিয়ে তিনি দারুণ কিছু পথ বাতলে দিয়েছেন সে
জন্যে ধন্যবাদ।), আর এর মধ্যে হঠাৎ স্বল্পভাষী কার্টুনিস্ট-আঁকিয়ে মানবেন্দ্র
গোলদারের ফোন। তাঁর চেনা তিনটি স্টলে যেন কমিক্স রাখা হয়- সেই সুবাদে রাখা হল
আদর্শ (মিলন ভাই), ছোটদের মেলা (শাহীন ভাই, যিনি গত ৫ বছর টানা আমাকে তাঁর
পত্রিকার জন্যে কমিক্স করতে অলেছেন আর আমি কাট মেরেছি)। সোজা কথা সব মিলিয়ে আমাদের
কমিক্স ই সম্ভবত এবারের বইমেলায় সবচেয়ে বেশী সংখ্যক স্টলে রাখা ছিল। ওদিকে মাঝে
শামীম আর আমি মিলে রকমারী ডট কমের সোহাগ ভাইয়ের সাথে কথা বলে এসেছি। তিনিও কমিক্স
এর কথা শুনে বিরাট উৎসাহ দেখালেন। বললেন কন্টেন্ট ভাল হলে রকমারি এর প্রোমশনালেও
কাজ করতে পারে, (কন্টেন্ট এর ব্যাপারে জায়গায় বসে পুরা ১০০ পার্সেন্ট গ্যারান্টি
দিয়ে দিল মোর্সালিন- সে রকমারিতেই ডিজাইনার হিসেবে কাজ করে, যতটা কনফিডেন্স এর
সাথে সে তা বল্ল আমরাই ঘাবড়ে গেলাম।) কিন্তু না, হাজারো বাধা বিপত্তি হতাশা থাকলেও
কাজে নেমে আমরা বুঝতে পারলাম এটা না করলে কি বোকামীটাই না হত। ঢাকা কমিক্স এর সাড়া
পড়লো অপ্রত্যাশিত। এবং মিডিয়ার চেনা-অল্পচেনা-অচেনা অনেকেই এটাকে হাইলাইট করলো।
চ্যানেল একাত্তরের পার্থদা আমাকে স্টল থেকে ধরে এনে বললেন- কমিক্স নিয়া বল।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভিতে আমাদের কমিক্স এর ওপর প্রায় পাঁচ মিনিটের কভারেজ করলো। সময়
টিভির বন্ধু জিমি ক্যামেরা ট্যামেরা এনেও সেদিন বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধে গণজাগরণ
মঞ্চ থাকায় সেটা কভারেজ করতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে কমিক্স কভার করতে পারলো না। ডেইলি
স্টার, নিউ এইজ, প্রথম আলো (বেসিক্যালি সিমু ভাই-আমাদের আসলে যার কাছে কমিক্স
দেবার কথা ছিল, এরেই বলে আইরনি), সমকাল, কালের কন্ঠ সবগুলিতেই আমাদের কমিক্স এর
রিভিউ বের হল। বাংলাদেশের একমাত্র কমিকবুক শপ জামিল ভাইয়ের ‘জামিল’স কমিক্স’ এ
জামিল ভাই এক কথায় আমাদের কমিক্স রাখতে রাজী হলেন। এমন কী নিজের থেকে উনি রাইজিং
স্টার এ এর একটা ছোট্ট রিভিউ লিখে দিলেন! এই সবকিছুর সাথে আমরা টের পেলাম-এইকাজে
আমরা একা না, আসলে সবাই এটাকে একেবারে নিজেদের করে ভাবছে। এটা একটা বিরাট পাওয়া। আসলে
এটা কোন প্রকাশনা ব্যবসা হিসেবে আমরা শুরু করিনি, এবং অন্যরাও কেউ এটাকে প্রকাশনা
ব্যবসা হিসেবে দেখছে না। এটা আসলে বাংলাদেশের কমিক্স হিসেবেই সবাই দেখছে। বিনা
চেষ্টায় মানুষের মনে আমরা ব্যাপারটা পুরে দিতে পেরেছি যে এটা আমাদের। এই অসাধারণ
ব্যাপারটা আমাদের যাবতীয় হতাশা ও দূর্ভোগকে মুছে দিল। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম
ক্রান্তিকালের মধ্যেও তাই আমাদের কমিক্স আশাতীত সাড়া ফেলল। আমরা সবার কাছেই কৃতজ্ঞ-
প্রেসের কালাম ভাইকে তাই ইতিমধ্যে বাকির খাতাটা আরো বড় করে ফেলতে বলা হয়েছে। পুরো
প্রজেক্ট দেখে বস দ্যা গ্রেইট আহসান হাবীব সবচেয়ে খুশী, নগদ টাকায় তিনি কপি কিনে
নিলেন, এবং কথা দিলেন পরবর্তী প্রডাকশনেই তাঁর নিজের একটি কমিক্স আমরা পাব!
আমরা
মেলা শেষে কমিক্স আঁকিয়েরা একটা ফ্রেনচ ফ্রাই সবাই ভাগাভাগি করে খেতে খেতে পরের
প্রডাকশনের দিনক্ষণ ঠিক করে শীষ বাজাতে বাজাতে বের হয়ে এলাম। বেলতলায় আবার যাব,
তবে চুল গজাবার জন্যে কিছুদিন অপেক্ষা এবার।
জয়
ঢাকা কমিক্স।