মানুষ নামের ভাইরাসটিকে প্রকৃতি সম্প্রতি তার ছোট্ট একটা টোটকা দাওয়াই দিয়ে ঘরে বসিয়ে রেখেছে। চারিদিকে আড়মোড়া ভাঙছে অন্যেরা। নিজেদের মহাবিশ্বের কেন্দ্র মনে করা মানুষেরা হঠাৎ টের পাচ্ছি আমাদের ছাড়া কারো কোন সমস্যা তো হচ্ছেই না বরং তারা যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। বাতাস পরিষ্কার হয়ে যাছে। পশুপাখিরা আগের চাইতে নির্ভয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। সেদিন দেখলাম দক্ষিণ আফ্রিকার পিচ ঢালা রাস্তায় এক দল সিংহ তাদের বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে আরামে ছায়ার মধ্যে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
করোনা ভাইরাসের এই সময়টাকে আমি মনে করি মানুষের জন্যে তার আত্মার আয়নায় তাকানোর সময়। হঠাত করে আমরা টের পাচ্ছি যে আমরা নিজেরা বেশ কিছু কাল্পনিক নিয়ম টিয়ম বানিয়ে বসে আছি। কাজ করতে হবে, ছুটতে হবে, প্রডাকশন প্রফিট, শেয়ার বাজার, ভোগ লালসা, সম্পত্তি, আরো চাই, আরো চাই, দিল মাঙ্গে মোর- ইত্যাদি। বন্ধু বান্ধব পরিবার পরিজন ইত্যাদি ছাপিয়ে আমাদের মূল সময় আমরা দেই এমন কিছু কাজে যা- হঠাৎ করে টের পাচ্ছি- অত জরুরী না। অনেক কিছু ছাড়াও এখন আমাদের চলে যাচ্ছে। চলে যায়।
আসলে করোনা ভাইরাসের এই সময়টা আমরা যারা পেয়েছি তারা যথেষ্ট ভাগ্যবান, কারণ যারা মারা যাব তারা তো যাচ্ছি, কিন্তু যারা বেঁচে থাকবো বা আছি তারা কিন্তু দূর্লভ একটা সময় পেয়েছি। সাধারণত মৃত্যু কাছাকাছি এলে শেষ বয়সে মানুষের এই সময়টা আসে যখন আসলে সময় বলে আর কিছু থাকে না, কাছের মানুষ অনেকেই গত হয়ে যায়, কাজের শক্তি থাকে না। কী কী ভুল করেছি তা মাথায় আসে বটে কিন্তু কিছু করার থাকে না। এখন কিন্তু তা না। আমরা অনেকেই (বিশেষ করে তরুণরা) একটা বড় সময় পাছি এসব নিয়ে ভাবার। মানুষের আসলে ঠিক কতটুকু কী প্রয়োজন তা বোঝার সময় এটা।
এই একটা সময়ে আমরা এটাও টের পেলাম যে পৃথিবীর মানুষ সব আসলে একই ধরনের। যাদের আমরা 'উন্নত' মনে করি তারাও আসলে অত উন্নত না। তারাও গুজবে বিশ্বাস করে, তারাও আমাদের মতই দায়িত্বহীন। সেখানেও অথর্ব সরকার আর সমন্বয়হীনতা আছে। তাই আমাদের স্বপ্নরাজ্য দেশগুলি থেকে আমরা যতটা দূরে বলে আমাদের ভাবি বাস্তবতা তা না। সবার নিজের মত করে নিজস্ব অনেক সমস্যা আছে। বরং বাংলাদেশের মানুষ এখনো অনেকটাই মানবিক, ঘরোয়া ধরনের। আর এ সময়ে আমাদের সরকারের আন্তরিকতা মানুষকে যথেষ্টই ছুঁয়ে দিচ্ছে। সময় সুযোগ মিললে তাই নিজের দেশটার ভালোর জন্যে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার এটা একটা দারুণ অনুপ্রেরণা হতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজের রুটিন খুব একটা পালটায় নি। সন্ধ্যায় পত্রিকা অফিসে যাওয়া বাদে বাকি সময়টা আমি এমনিতেও বাসাতেই থাকি। অনেকেই (বিশেষ করে 'ছেলে' দের) দেখলাম ঘরের কাজ করতে করতে নাকে চোখে পানিতে একাকার। এটাও একটা শিক্ষা যে ঘরের কাজ করা উচিত সবারই। এবং সেটা অন্যকে 'সাহায্য' করার জন্যে না। নিজের ঘরের কাজ নিজে করলে সেটাকে সাহায্য বলে না। সেটাকে বলে কাজ।
মাঝে মাঝেই ফোনে (এখন তো আবার ভিডিও কলের যুগ) কথা হয় আত্মীয় স্বজন, বন্ধুদের সাথে, যাকে দুই চোখে দেখতে পারিনা তাকেও মিস করি, মনে হয় আহা এর সাথে যদি আর দেখা না হয়!
ফোন দেই আমার জীবনের গুরু আহসান ভাইকে (কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব), উন্মাদ এই চান্সে ডিজিটাল করা যায় কি না তা নিয়ে চারশ ছত্রিশতমবার আলোচনা চলে, মিরপুরের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ এলাকার একটা হলেও মানুষজন সেখানে পিকনিকের আমেজে ঘোরাঘুরি করছে বলেন বস।
সেদিন হঠাৎ ফোন করলেন ধ্রুবদা' (ধ্রুব এষ)। পল্টনের ফ্ল্যাটে একেবারে একা আটকা পড়ে আছেন, সারাদিন জানালার পাশে বসে থাকেন। এই মানুষটা খুবই অন্য রকম, আমার কাছে মনে হয় একটা উড়ে যেতে থাকা আত্মা হঠাৎ মাটিতে থাকা একটা দেহে আশ্রয় নিয়েছে। তার আসলে এখানে এই পৃথিবীতে থাকারই কথা না। মহামারীর এই সময়ে চারিদিকে মানুষের ভাবলেশহীন ঘোরাঘুরি দেখে মাঝে মাঝে আঁতকে ওঠেন, খবর টবর দেখে আবার ঢুকে যান নিজের জগতে।
খবর যেখানে পণ্য সেখানে হয়েছে আরেক বিপদ। না চাইলেও খবর আর তার লেজ ধরে 'টবর' (ফেইক নিউজ), এবং তার সাথে ফোঁড়া হিসেবে অকালপক্ক গাঁড়লদের 'কমেন্ট' মানে কে কী বলল না বললো ইত্যাদি নিয়ে অকারণ মাথা গরম করে ঘুরছে সবাই। সত্যি বলতে এইসব যা নিয়ে আমরা মাথা গরম করছি তার নিরানব্বই ভাগেরই আমার জীবনে কোন ভূমিকা নেই, আমারও সেসব নিয়ে কিছু করার নেই। সবকিছুকেই একটা ভয়ানক সংকট হিসেবে উপস্থাপন করে মানুষকে বিপন্ন বোধ করিয়ে পণ্য বিক্রির মত এই খবর বিক্রি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে নষ্ট করছে। এত তথ্য আমার জানতে হবে কেন? যেটা প্রয়োজন নেই সেটাও আমি জানছি আর মাথা গরম করছি। এরকম কালবৈশাখী ঝড়ে উড়ে আসা পশলা বৃষ্টির মত তথ্যের বৃষ্টি মাথা নষ্ট করে দেবার জন্যে যথেষ্ট। যাচাই করার মত কোন ছাতা নেই মাথার ওপর। বয়স্কদের জন্যে এই ব্যাপারটা আরো ভয়ানক। হালে তাঁদের হাতেও চলে এসেছে 'স্মার্ট' ফোন আর সেই সাথে ফেইসবুক। সেখানে কোনটা আসলেই ঘটেছে আর কোনটা মিথ্যা সেটা যাচাই করা তাদের জন্যে আরো কঠিন। ফলে শেষ বয়সে তাঁদের একটা অকারণ উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছে। এর হাত থেকে রেহাই পাবার উপায় কি কে জানে! গুজব ভাইরাস আসল ভাইরাসের চাইতে খারাপ বস্তু। সেই ভাইরাসকেও থামাবার উপায় খুঁজতে হবে আমাদের।
সব শেষে প্রবল আতংকের এই সময়টাতেও আমি আমাদের জন্যে পজিটিভ অনেক কিছু দেখছি। কিছু মানুষের যদি কিছু উপলব্ধি হয়, যাদি তারা বোঝে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য টাকা বানানোই নয়, সম্পত্তি বানানোও নয়। জীবনটা ছোট, আমরা যা ভাবি তার চাইতেও অনেক ছোট। সেই সময়টা প্রিয় মানুষদের নিয়ে ভালো থাকাটাই আসল। প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণিদের মতই আমরাও আরেকটা প্রাণি ছাড়া আর কিছুই না। অন্য প্রাণিদের বা প্রকৃতির কোন কিছুকেই নষ্ট করার বা কষ্ট দেবার কোন অধিকার আমাদের নেই। মানুষের প্রয়োজন খুবই সীমিত। অনেক কম নিয়েও ভালভাবেই থাকা যায়। অন্যের সাথে তুলনা না করে নিজের সর্বোচ্চ ভালটা চেষ্টা করে থাকলেই একটা সুখী জীবন পাওয়া যায়। এই সব কিছুর কিছুটাও যদি আমাদের বোধে আসে তো সেটা এই সময়টার জন্যে। হয়ত একটা সময় আমরা এই আপাত অমানিশার সময়টকে তার জন্যে ধন্যবাদই জানাবো।