জীবনের এ পর্যন্ত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট শেষের পথে। পৃন্ট মিডিয়ার কাজ যতই ভাল হোক সব পৃন্ট হাতে না আসা পর্যন্ত আতংক গলার কাছে আটকে থাকে। কখন কোথায় কী ঘটে যায় বলা যায় না। যেমন এবারেই টেক্সট বইয়ের পৃন্ট ভার্সন করার আগে যা হল তা নিয়ে 'ছাপাখানার ভুত ভুতং ভুতৌ ও অন্যান্য' নামে একটা বই লিখে ফেলা যাবে। পৃন্ট শুরু হবা এক সপ্তাহ আগে কি মনে করে সব পেইজ খুলে চেক দিচ্ছিলাম। হাজার ফাজার পৃষ্ঠা একটা একটা করে ইপিএস ফরম্যাট দেখার একমাত্র সহজ উপায় হল এডোবি ব্রিজ এ থাম্ব ভিউ দিয়ে জুম করে দেখা। তাতে যা যা ধরা পড়ল তা দেখে আক্কেল গুড়ুম সবার। এডোবির অতি স্মার্ট ইপিএস এক্সপোর্ট পদ্ধতি যত ধরনের ফর্মুলা আছে সব পালটে আরেকটা ফন্ট করে দিয়েছিলো। অতঃপর এনসিটিবির অফিসে গিয়ে মূল গ্রাফিক অপারেটরের সাথে বসে পুরো টিম মিলে বলতে গেলে আবার সব ধরে ধরে সব পৃষ্ঠা ঠিক করতে হয়েছে, কষ্টের কাজটা এনসিটিবির টিমই করেছে শেষে। সব ঠিক করার পরেও মনের মধ্যে এবার ভয় ঢুকে গেল। বিকট সব স্বপ্ন দেখা শুরু হল আমার আর মিতুর।
আমি দেখলাম, স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা, আমার বায়োলজি স্যার প্রশ্ন দিতে দিতে হাসিমুখে বললেন-
- 'সব কিন্তু এজ ইটিজ আঁকবি। আর মনে রাখবি, সব রঙ করতে হবে।'
- 'রঙ করার টাইম হবে না স্যার' আমি আতঙ্কে বললাম।
- 'টেক্সট বই আঁকার সময় খেয়াল ছিলো না? হাহাহাহা' (কুৎসিত হাসি)
আমার সবচেয়ে প্রিয় বায়োলজি স্যারের এইরকম শত্রুতা দেখে জেগে উঠে পরদিন আবার মিতু দেখলো ফিজিক্স বইয়ের সব ফন্ট সফটওয়ারের কারণে চাইনিজ ফন্ট হয়ে গেছে। এবং বাংলাদেশের সব পত্রিকায় এ বিষয়ে চীনের শি জিন পিং আনন্দ বার্তা জানিয়েছেন।
এইসব কারণে আমরা মুখ শুখনা করে ঘোরা শুরু করলাম। মিডিয়ার কল্যাণে আর নিজে পণ্ডিতি করে ব্লগে লিখে দুনিয়ার সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি আমরা এই প্রজেক্টে আছি, তাই পরে পালানোরু উপায় নেই। হঠাত একদিন স্যারের ফোনে জানলাম পৃন্ট শুরু হচ্ছে। শুনে রীতিমত প্রেশার হাই হয়ে গেল আমাদের। এবং কিছুদিন পর আবার একদিন স্যারের কল আসলো। এনসিটিবি থেকে তাঁকে দাওয়াত করা হয়েছে কিভাবে পৃন্ট হচ্ছে তা দেখতে। আমরা যেতে চাই কি না। অবশ্যই চাই। এক শুক্রবার সকালে এনসিটিবির কর্মকর্তা রতন সিদ্দিকী তাঁর বিরাট গাড়ি নিয়ে এলেন স্যারের বাসায়। রওনা হলাম, স্যার, ইয়াসমীন ম্যাডাম, স্যারের মেয়ে ইয়েশিম আর আমি-মিতু। প্রেস নাকি সব মাতুয়াইলে! এত দূরে যেতে হবে আগে বুঝিনি। কিন্তু বড় বড় সব প্রেস নাকি সব ওখানেই। বিশেষ করে এনসিটিবির পৃন্ট ওখানেই হয়। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ প্রিন্টিং। ৩৫ কোটি বই প্রতি বছর! স্যারের এনালাইসিস সব বই পর পর রাখলে পুরো পৃথিবী ৬ বার প্রদক্ষিণ করতে পারবে। এটা একটা বিশ্ব রেকর্ড, প্রজেক্টটা করার আগে আমার কোন ধারনা ছিলো না। এবং মাতুয়াইলে গিয়ে প্রেস দেখে আমি আর মিতু একসাথে বললাম- 'বাপরে!'
গলি তস্য গলি পাড় হয়ে যেই প্রেসেই ঢুকি সেখানে এলাহী কাণ্ড। মেশিনের পর মেশিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একের পর এক বই বের হচ্ছে। এখানে বড় বড় শিট হাতে ভাঁজ করে ফর্মা (সবচেয়ে বড় যে শিটে একসাথে ছাপা হতে পারে, পরে এটাকে ভাঁজ দিয়ে বা কেটে বইয়ের মাপে আনা হয়) করা লাগে না। মেশিনই ফর্মা ভাঁজ করে দেয়। আর পৃন্ট থেকে বাইন্ড পর্যন্ত ধরে একটা প্রেস দিনে বই ছাপতে পারে এক লক্ষ! আমার আগে ধারনা ছিলো শুধু চায়নাতেই এটা করা যায়। এবারে জানলাম আমাদের পৃন্টিং কত দ্রুত আরো কত পেশাদারি জায়গায় চলে যাচ্ছে। আর পৃন্ট? আমার আগের দেখা যে কোন টেক্সট বইয়ের চে' কাগজ ভালো, পৃন্ট কোয়ালিটিও দারুণ। দুই এক জায়গায় টুকটাক কারিগরি সমস্যা যে হচ্ছে না তা না। তবে এখন থেকে আর আমরা দুঃস্বপ্ন দেখবো না আর এটা নিশ্চিত। লেখা আর না বাড়িয়ে ছবিতে আর ভিডিওতে বাকিটা শেষ করা যাক।
|
পদার্থবিজ্ঞান আর জীববিজ্ঞানের ফুল শিট প্রচ্ছদ সহ আমি, প্রেস মালিক (নাম মনে নেই :/) ইয়াসমীন ম্যাডাম, স্যার, মিতু |
|
ঝকঝকে রসায়ন বই। |
|
সরেজমিনে পৃন্টিং দেখতে স্যার একটা মেশিনের পাটাতনে, বাঁয়ে প্রেসের ম্যানেজার (নাম মনে নেই :/) ডানে রতন সিদ্দিকী সাহেব। |
|
(নাম মনে নেই -ম্যানেজার) স্যার, ম্যাডাম, আর স্যারের মেয়ে ইয়েশিম। |
|
জীববিজ্ঞান (জেনারেল লাইন) |
|
জীববিজ্ঞান (মাদ্রাসা লাইন) |
|
সরেজমিন |
প্রিন্টিং প্রক্রিয়া
বাঁধাই চলছে