কেন আঁকি?-
এটা অনেকটা দার্শনিক প্রশ্নের মতন। অনেকটা 'কেন এ জীবন'- ধরনের। চাণক্যের শ্লোক মতে যে কোন কাজের আগে প্রথম যে প্রশ্নটি নিজেকে করতে হবে সেটি হল- 'কেন?' সত্যি বলতে নিজের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা আমার কাছে সবসময় একটা দুরূহ ব্যপার বলে মনে হয়েছে। অনার্স থার্ড ইয়ারে থাকতে কোন এক ফান সাপ্লিমেন্টে (নাম ভুলে গেছি) আমাদের কার্টুন আঁকিয়েদের একটা প্রশ্নপত্র জরিপ টাইপ অণু সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়েছিলো। সেখানে একটা প্রশ্ন ছিল- কেন আঁকেন। আমি অনেক ভেবে লিখেছিলাম- 'আর কিছু পারি না তাই'। কিন্তু পরে মনে হল কথাটা তো ঠিক না। ছাপা হবার পর দেখি ব্জমজ বন্ধু মানিক-রতন আসল উত্তরটা ঠিকি লিখেছে। তারা লিখছে- ভাল্লাগে তাই আঁকি। আসলে উত্তরটা এতটাই সহজ। ভাল্লাগাটা আসলে সবার আগে। ক'দিন আগে আমেরিকান কিংবদন্তীতূল্য ক্যারিকেচারিস্ট যেসন সেইলার এর একটা ভিডিও পডকাস্ট দেখলাম। সব কিছুর শেষে উনি বললেন-
Drawing is Fun, and it should be fun.
কি দারুণ একটা কথা। এমনকী জীবনটাকেও কি আসলে এভাবে ভাবা যায় না? ধরে নেয়া যায় না
Life is fun, and it should be fun?
আমার এই ছোট্ট আঁকাআঁকির জীবনে আমি একটা অদ্ভুত উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে গেছি। আমার মনে হয় হয় যে কোন আঁকিয়ের সাথে এটা ভাগাভাগি করে নেয়া উচিৎ। আমি প্রথম যখন পত্রিকায় আঁকতে শুরু করি যখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। তখন আমার বয়স ১৩। দৈনিক সমাচার নামের একটি পত্রিকায় আমার বাবা নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন। সেখানে একটা রাজনৈতিক কলামে আমি একটা কার্টুন আঁকি। সেটার বিষয়বস্তু বলার লোভ সামলাতে পারছি না, কার্টুনটা আঁকার আগের দিন আমার গৃহ শিক্ষক কামরুল স্যার রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতার চার লাইন শুনিয়েছিলেন ''রথ ভাবে আমি দেব পথ ভাবে আমি, সূর্য ভাবে আমি দেব- হাসে অন্তর্যামী।" আমার সেটা এতই ভাল্লাগে যে আমি সেখানে রথ, পথ আর সূর্যে দেশের মূল ধারার তিন প্রধানকে বসিয়ে শেষে অন্তর্যামীর লাইনটাও জুড়ে দেই। ক্লাস এইটের এক পিচচির জন্যে সেটা বাড়াবাড়ি রকমের প্রগলভতা। তবে বাসার সবাই দারুণ উত্তেজিত ছিল। আমার বাবা আমাকে পারিশ্রমিক হিসেবে গোটা একটা ৫০ টাকার নোট ধরিয়ে দিলেন! এবারে উত্তেজনা আমাকেও সংক্রমিত করল। আমি আঁকা শুরু করলাম। সত্যি বলতে তখন আমার কাছে উত্তেজনার কারণটা ছিল আমি আমার বাসার টেবিলে একটা কিছু আঁকছি আর সেটাই ঠিক সেভাবে রীতিমত পত্রিকায় ছাপা হয়ে যাচ্ছে! ছাপা হওয়া কপি ঘন্টার পর ঘন্টা আমি চোখের সামনে ধরে রাখতাম। কেমন অদ্ভুত একটা ভালো লাগা বোধ হত। ক্লাস নাইন এ ওঠার পর আমি ভোরের কাগজে রঙ্গব্যাংক পাতায় কার্টুন করতে শুরু করি। ততদিনে বিক্রম সুগন্ধা নতুনপত্র ইত্যাদি সাপ্তাহিকী তে ফিলার আঁকিয়ে হিসেবে সমানে এঁকে যাচ্ছি। রঙ্গব্যাংক এ আঁকার পরেই আমার এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। ব্যাপারটা আর কিছুই না, তদ্দিনে আমি বুঝে গেছি যে আমার এইসব অকারণ আঁকিবুকির জন্যে রীতিমত পকেট খরচও পাওয়া যায়। পত্রিকার লোকজন আঁকার জন্যে টাকাও দেয়! তাই আমার তখন ইচ্ছে হত অনেক আঁকব তাহলে অনেক টাকা হবে। টাকাকে তখন কন্ট্রিবিউটরদের ভাষায় বলতাম 'বিল'। তো ভোরের কাগজে আঁকবার পর সেই বিল পাওয়াটা হঠাৎ করেই অতি দুঃসাধ্য হয়ে গেল। টাকা তুলতে গেলে ভোরের কাগজের একাউন্টসের দুই একাউন্টেন্ট দাঁতকেলিয়ে বলে - 'টাকা তো নাই। মঙ্গলবার আসেন।' মঙ্গলবার আবার যাই তারা পরের মঙ্গলবার আসতে বলে। আক্ষরিক অর্থেই তখন জুতার শুখতলা ক্ষয়ে যাবার দশা। তখন থেকে ধীরে ধীরে আমি খেয়াল করলাম আমার আঁকতে আর ভাল্লাগছে না। মেজাজ খিঁচড়ে যাচ্ছে। এবং আঁকার মান দিন দিন খারাপ হচ্ছে। কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। ভয়ানক মন খারাপ করে বাংলামটরের রাস্তা পার হই আর ঐ দুই একাউন্টেন্টকে গালাগাল করি। এমনি সময়ে একদিন বাসায় বসে পুরোনো বইয়ের শেলফ গোছাচ্ছিলাম, হঠাৎ চোখে পড়ল আলেক্সান্দার বেলায়েভের উভচর মানুষ বইটা, সেই প্রথম রাদুগা সংস্করণ। এই বইটা অনেকেরই প্রিয়, কিন্তু আমার আরো বেশী প্রিয় এর অলংকরণের জন্যে। সাদা কালোতে আঁকা এই অসামান্য আঁকিয়ের কাজ আমি মুগ্ধ হয়ে বারবার দেখি। সেদিন এটা দেখেই আমার আঁকতে ইচ্ছে করল। নাগাড়ে কয়েকটা ছবি পর পর এঁকে ফেললাম। এবারে সেগুলো দেখতে দেখতে আমি খেয়াল করি গত একটা বছর আমি এভাবে 'নিজের জন্যে' কিছুই আঁকিনি। মানে যাই এঁকেছি তা আসলে কোথাও না কোথাও ছাপা হয়েছে। কিন্তু এই ছবি ক'টা কপি করে আমি খুবই আনন্দ পেয়েছি। আমার একটা হারানো অনুভূতি যেন ফিরে পেয়েছি। আমি ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা ভাবলাম। এবং বুঝলাম এখানে টাকা পাবার কোন সম্ভাবনাই ছিলো না, আমি আসলে নিজের জন্যে মজা নিয়ে এঁকেছি, আর সে জন্যেই এটা এত ভালো লেগেছে। আর ওদিকে যেসব আমি টাকার জন্যে আঁকছি সেসবের জন্যে না পাচ্ছি টাকা না পাচ্ছি আনন্দ। তাহলে অন্তত আনন্দটা নেয়া যাক। ধরে নেই টাকা আসলে পাবো না। মানে টাকার জন্যে আসলে আঁকছি না। নিজের জন্যে আনন্দ নিয়ে আঁকছি। তাহলে সেটায় সর্বোচচ মনোযোগটাও দেয়া যাবে। একেবারে গল্পের মত যে ভাবা সেই কাজ। এবং ফলাফল হাতে নাতে, আমি আমার আনন্দ খুঁজে পেলাম। যাই আঁকি ভালো লাগে, আরো মনোযোগ দিয়ে সব স্টাডি করি। স্কেচ খাতা ভরতে থাকে। সেরা আঁকিয়েদের আঁকা কপি করি। যেই আঁকতে বলে রাজী হয়ে যাই। এবং নিজের মত করে আঁকি। এতে আরেকটা যেটা মজার ব্যাপার হল যেহেতু টাকাটা মূখ্য না তাই কোন কাজ ভালো না লাগলে সরাসরি 'না' বলে দেয়াটা এখন অনেক সহজ হয়ে গেল। অর্থাৎ আমার কাছে এখন Drawing is fun.
আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া সেই ড্রয়িং গুলির একটি, ক্লাস টেনে আঁকা। আমার পুরোনো একটা ফাইলে খুঁজে পেলাম |
এর ঠিক পরপরই ঘটল সবচেয়ে দারুণ আর অদ্ভুত ঘটনা। আমি বিল পেতে শুরু করলাম! তার মানে কি এদ্দিন আমার আঁকায় গাফিলতি ছিল বলে বিল পাই নি? নাকি আসলে এই সময় পর্যন্ত আমাকে এমনিতেও অপেক্ষা করতে হত? আমি জানি না। জানার আসলে দরকারও নেই। কারণ তদ্দিনে আমি আঁকার মজাটা আবার ফিরে পেয়েছি। আর ফিরে পেয়েছি নিজের মুড। অর্থাৎ যা করব তা নিজের মত করেই করব।
এই এখনো আমি সেই একই নিয়মে কাজ করি। এবং আমার মনে হয় আঁকিবুকি করাটা Should be fun। সেটা চলে গেলে সবই আস্তে আস্তে চলে যায়। বিরাট এক হেঁয়ালির মতন, আমার উপলব্ধি হল ক্রিয়েটিভ সেক্টরে আপনি টাকার আশা করলে সেটা আসবে না, আসবে তার আশা ছেড়ে কাজ করে গেলে। সত্যি বলতে খালি টাকা না, খ্যাতি, নাম ডাক ইত্যাদিও আসলে তাই। আপনি যদি এগুলোর পেছনে ছোটেন তবে নিজের দুঃখই খালি বাড়ে। তার চেয়ে আনন্দ নিয়ে নিজের কাজটা ১০০ ভাগ করে গেলে বাকিগুলি তার বাই প্রডাক্ট হিসেবেই আসে। বিশ্বাস না হলে শুরু করে দেখেন।